যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা : ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর তাৎপর্য
কাশ্মীর ইস্যুতে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ভারত বুধবার ভোরে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
ভারতীয় সামরিক বাহিনী এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন সিন্দুর’। পাকিস্তানের সামরিক সূত্র জানাচ্ছে, তারা এর পাল্টা জবাব দিয়েছে এবং ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে।
উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলায় বেসামরিক হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
পাকিস্তানের সামরিক সূত্র অনুসারে, ভারতীয় হামলায় অন্তত ২৬ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরও ৪৬ জন।
নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।
পাকিস্তানের আন্তঃ-সামরিক জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট আহমেদ শরিফ চৌধুরী জানিয়েছেন, ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের ৬টি শহরে আঘাত হেনেছে।
অন্যদিকে, ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানের ৯টি স্থানে আঘাত হেনেছে।
এই হামলার মূল কারণ হিসেবে জানা যায়, গত ২২শে এপ্রিল ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরের পাহালগামে একদল পর্যটকের ওপর হামলা হয়, যেখানে ২৬ জন নিহত হয়েছিল।
‘দ্য রেসিস্টেন্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার করে।
ভারত সরকার মনে করে, টিআরএফ হলো পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার (এলইটি) একটি শাখা।
যদিও পাকিস্তান এই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
এই ঘটনার পর ভারত, পাকিস্তানের জল সরবরাহ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ সিন্ধু জল চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান, ১৯৭২ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে।
দুই দেশই কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে দিয়েছে এবং একে অপরের নাগরিকদের বহিষ্কার করেছে।
ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা জঙ্গি অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) এবং জয়েশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম)-এর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো।
উল্লেখ্য, জয়েশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর ওপর আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করেছিল, যেখানে ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়।
ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করা এবং ভারতে সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা কমানো’।
ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ভ্যোমিকা সিং এই অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
তাদের মতে, ৯টি লক্ষ্যের মধ্যে ৫টি ছিল পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে এবং বাকি ৪টি পাঞ্জাবে অবস্থিত।
সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ২১টি ‘সন্ত্রাসী শিবিরের’ একটি মানচিত্র দেখিয়েছিল।
তবে, আল জাজিরা উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
আইএসপিআরের চৌধুরী ভারতীয় হামলাকে ‘নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো বিনা উস্কানির আক্রমণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি জানান, ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের ৬টি স্থানে মোট ২৪টি হামলা চালিয়েছে।
হামলায় মসজিদ ও আবাসিক এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে হওয়া চারটি যুদ্ধের বাইরে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে এটিই ভারতের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথম ভারত পাকিস্তানের জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে হামলা চালিয়েছে।
তবে, ভারতের হামলার লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচিত স্থানগুলোর কিছু কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে।
নিচে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
* মুরিদকে: পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলার এই শহরটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন বহন করে।
ভারতের দাবি, এখানে লস্কর-ই-তৈয়বার (এলইটি) সদর দপ্তর রয়েছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, তারা মুরিদকের ‘মার্কাজ তাইবা’ ক্যাম্পে আঘাত হেনেছে।
তাদের মতে, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
* আহমদপুর শারকিয়া (বাহাওয়ালপুরের কাছে): এখানে একটি মসজিদে হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে অন্তত ৫ জন নিহত হয়।
ভারত দাবি করেছে, তারা এখানে জয়েশ-ই-মোহাম্মদের (জেইএম) সদর দফতর ‘মার্কাজ সুবহানাল্লাহ’-তে আঘাত হেনেছে।
* মুজাফফরাবাদ: পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের রাজধানী এটি।
এখানে একটি মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে এক শিশু আহত হয়েছে।
ভারত বলছে, তারা এখানে লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘সাওয়াই নালা ক্যাম্পে’ আঘাত হেনেছে।
* কোটলি: এখানে একটি মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে এক কিশোরীসহ দুইজন নিহত হয়েছে।
ভারত দাবি করেছে, তারা এখানে লস্কর-ই-তৈয়বার ‘গুলপুর ক্যাম্পে’ আঘাত হেনেছে।
* ভিমবার: ভারতীয় কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তারা এখানে হিজবুল মুজাহিদিনের (এইচইউএম) একটি ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে।
* সিয়ালকোট: পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র এটি।
এখানে একটি গ্রামে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে।
ভারত দাবি করেছে, তারা এখানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে, যেখান থেকে চলতি বছরের মার্চে ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরে ৪ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
* শাকার গড়: এখানে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে।
ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা অবশ্য এই স্থানটিকে হামলার লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করেননি।
বর্তমানে, উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে।
এই পরিস্থিতিতে, শান্তি ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত হস্তক্ষেপ করা জরুরি।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা