যুদ্ধ নয়, গণতন্ত্র ধ্বংসের পথে ভারত!

ভারতে ‘নতুন স্বাভাবিক’-এর নামে গণতন্ত্রের অবক্ষয়?

সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কয়েকদিন পরেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী সামরিক অভিযান ‘সাময়িকভাবে স্থগিত’ রেখেছে, কিন্তু গত ২২শে এপ্রিল কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের ঘটনার পর শুরু হওয়া ‘অপারেশন সিন্দুর’ এখনো শেষ হয়নি।

মোদি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এখন অপারেশন সিন্দুর ভারতের নীতি। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি একটি নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে এবং নতুন স্বাভাবিকতা স্থাপন করেছে।’

প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণটি স্পষ্টতই ভারতের জনগণকে নিরাপত্তা প্রদানের আশ্বাস দেওয়ার জন্য ছিল না, বরং এটি ছিল দেশের মানুষকে সতর্ক করা যে তারা এখন একটি স্থায়ী যুদ্ধাবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র সমর্থকগোষ্ঠীকে খুশি করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

পাহালগাম হামলার পর রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলো যে তৎপরতা দেখিয়েছে, তা তাদের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। হামলায় নিহত নৌ-কর্মকর্তা বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী নারওয়াল শান্তি ও মুসলিম এবং কাশ্মীরিদের ওপর হামলা বন্ধের আহ্বান জানালেও, বিজেপি প্রতিশোধের আহ্বান জানায় এবং মুসলিম বিরোধী কথাবার্তা শুরু করে।

হামলার পর সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার দায় নেয়নি, বরং এটিকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। এরপর দ্রুত মুসলিম ও কাশ্মীরিদের ওপর হামলা চালানো হয় এবং যারা সরকারের সমালোচনা করেছিল, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকটি বাড়িঘর উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং কয়েক হাজার মানুষকে আটক করা হয়। এমনকি, পাকিস্তানের পাসপোর্টধারীদেরও বিতাড়িত করা হয়, যা পরিবারগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

এরপরই ঘোষণা করা হয় ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর কথা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যখন পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হচ্ছিল, তখন মূলধারার গণমাধ্যমে পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে বলে খবর প্রচার করা হয়।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেল মিথ্যাভাবে জানায় যে করাচি বন্দর ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করেছে।

বিজেপির সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি হওয়ার মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার বিষয়টি তাদের হতবাক করে। এটিকে তারা দুর্বলতা হিসেবে দেখেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ায় অনেক বিজেপি সমর্থক পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রকে আক্রমণ করে এবং তাকে বিশ্বাসঘাতক ও কাপুরুষ বলে অভিহিত করে। এমনকি তার মেয়েকেও অনলাইনে হয়রানি করা হয়।

অন্যদিকে, ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস’-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২২শে এপ্রিল থেকে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১৮৪টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে হত্যা, হামলা, ভাঙচুর, ঘৃণা ভাষণ, হুমকি, ভীতি প্রদর্শন এবং হয়রানির মতো ঘটনাও রয়েছে।

যদিও বিক্রম মিশ্র দাবি করেছেন যে ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ রয়েছে, তবে ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর উদ্দেশ্য এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সমালোচকদের তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

সরকারের সমালোচনা করার জন্য সংসদীয় বিতর্কের প্রয়োজন, কিন্তু সরকার বিরোধী দলগুলোর সংসদ আহ্বানের আহ্বানকে উপেক্ষা করছে, যা গণতান্ত্রিক আলোচনাকে ব্যাহত করছে।

প্রধানমন্ত্রী যেহেতু ঘোষণা করেছেন যে ‘অপারেশন সিন্দুর’ এখনো শেষ হয়নি, তাই এখন ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে পূর্ণ আনুগত্য দাবি করা হবে। বিরোধী দলগুলো সরকারকে কোনো প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকবে।

মুসলিমদের নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করতে হবে। সরকার যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সহজেই এর দায় চাপাতে পারবে। এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, তবে তা কেবল বিজেপির পক্ষে কথা বলার জন্য।

এভাবে, ভারত যখন স্থায়ী শত্রু এবং স্থায়ী যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছে, তখন দেশটির গণতন্ত্র স্থগিত অবস্থায় রয়েছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *