১৯৬০-এর দশকে, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য এক অদম্য চেষ্টা চালিয়েছিল। সেসময় শ্বেতাঙ্গ সমাজের নানান বৈষম্যের শিকার হয়েও তারা হাসি-আনন্দে নিজেদের জীবন সাজিয়েছিল।
সিডনির রেডফার্ন এলাকার আদিবাসী নারীদের জীবনযাত্রা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে, যার নাম ‘বিগ গার্লস ডোন্ট ক্রাই’।
নর্মা ইনগ্রাম নামের এক আদিবাসী তরুণীর কথা ধরা যাক।
১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসের এক শুক্রবার, সিডনির প্যাডিংটন টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আদিবাসী ডেবিউটেট বল। সমাজের চোখে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী নারীদের “সমাজজীবনে প্রবেশ” করানোর জন্যই এই আয়োজন করা হয়েছিল।
ইনগ্রাম জানান, অনুষ্ঠানে প্রায় ২০০ জন আদিবাসী মানুষজন উপস্থিত ছিলেন। বুমেরাং আকারের একটি প্রবেশদ্বার পেরিয়ে তারা হলঘরে প্রবেশ করেন। হলঘরটি সজ্জিত ছিল আদিবাসী মোটিফ ও নানা রঙের আল্পনায়।
ইনগ্রাম পরেছিলেন সাদা গাউন। তিনি বলেন, “আমরা সবাই তখন কিশোরী ছিলাম। আমাদের জন্য এটা ছিল দারুণ আনন্দের, আর আমরা অনেক নতুন বন্ধু তৈরি করেছিলাম।”
ইনগ্রামের বাড়ি ছিল নিউ সাউথ ওয়েলসের কাউরা শহরে, কিন্তু কাজের খোঁজে তিনি রেডফার্নে চলে আসেন। সেখানে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে আশ্রয় খুঁজে পান।
রেডফার্ন স্টেশনে নেমে তিনি ‘এমপ্রেস’ হোটেলে যেতেন, কারণ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য ঐ একটাই পাব (pub) খোলা ছিল। ইনগ্রাম হাসতে হাসতে বলেন, “আমি আমার কোনো এক আত্মীয়ের খোঁজ করছি—এই কথা বলার পরেই সবাই আমার দিকে তাকাতো।”
রেডফার্নে আদিবাসী মানুষেরা সাধারণত বাড়ি ভাড়া পেত না। যারা ভাড়া পেত, তারা তাদের সব আত্মীয়-স্বজনকে সেখানে নিয়ে আসত। এ কারণেই বাড়িগুলো সবসময় লোকে লোকারণ্য থাকত।
এই ডেবিউটেট বলের আয়োজন করে ‘ফাউন্ডেশন ফর অ্যাবরিজিনাল অ্যাফেয়ার্স’। তারা রেডফার্ন টাউন হলে নাচের অনুষ্ঠান এবং জর্জ স্ট্রিটে তাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রতি সপ্তাহে কনসার্টের আয়োজন করত।
রবিবার রাতে ‘সিলভা লিনিংস’ নামের একটি আদিবাসী ব্যান্ড সঙ্গীত পরিবেশন করত। সঙ্গীত প্রতিভার অধিকারী যে কেউ মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ পেত।
ইনগ্রাম ও তাঁর বন্ধু মার্জোরি, বার্টি এবং জিমি প্রায়ই মঞ্চে উঠে ‘গো-গো ডান্স’ করতেন, যা দর্শকদের আনন্দ দিত।
ইনগ্রামের নাতনি, গুম্বাইংগির/উইরাজুরি নাট্যকার ও অভিনেত্রী ডালারা উইলিয়ামস তাঁর নানি ও মাসিদের নাচের গল্প, হাসির গল্প শুনে বড় হয়েছেন।
ডালারা বলেন, “বৈষম্যের মধ্যেও তারা নিজেদের সাজিয়ে গুছিয়ে নিত এবং যেখানে তাদের যাওয়ার অনুমতি ছিল, সেখানে গিয়ে নাচ করত।” তিনি আরও যোগ করেন, “বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে আনন্দ খুঁজে পেত।”
এই গল্পগুলো থেকেই ডালারার নতুন নাটক ‘বিগ গার্লস ডোন্ট ক্রাই’-এর জন্ম। এপ্রিল মাসেই বেলভোর সেন্ট থিয়েটারে এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হবে।
নাটকের গল্পে দেখা যাবে, ১৯৬৬ সালে রেডফার্নের তিনজন তরুণী— যাদের একজন চেরিল, নিজেদের আনন্দ খুঁজে বের করার জন্য একটি ডেবিউটেট বলে অংশ নেয়।
ডালারা ১৯৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং রেডফার্নের ‘দ্য ব্লক’-এ বেড়ে ওঠেন।
এটি একসময় আদিবাসী আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল। তিনি বলেন, “আমি কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বড় হয়েছি।”
ডালারার মা ১৯৭০-এর দশকে ‘মুরাউইনা’ নামে একটি শিশু কেন্দ্র তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। সেই সময়েই রেডফার্ন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম আদিবাসী-মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রিত আইন ও চিকিৎসা পরিষেবা কেন্দ্র এবং ন্যাশনাল ব্ল্যাক থিয়েটারের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়।
ডালারা এখনও রেডফার্নেই থাকেন।
তিনি ২০০৪ সালে কিশোর থমাস “টিজে” হিকির মৃত্যুর পর পুলিশের বর্বরতা ও অস্থিরতার স্মৃতিচারণ করেন। তিনি এখানকার আদিবাসী মানুষদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়াকে ‘উপনিবেশের দ্বিতীয় আগমন’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
ডালারা বলেন, আদিবাসী মানুষেরা আনন্দ খুঁজে নিতে খুবই পারদর্শী। তিনি আরও যোগ করেন, “যদি আমরা ঘৃণা, হতাশা, আর রাগ নিয়েই অন্যদের সঙ্গে লিপ্ত থাকি, তবে আমরা দ্রুতই ভেঙে পড়ব। তাই নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার জন্ম দিতে হবে, যাতে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।”
বেলভোর-এর মহড়া কক্ষে নানির পাশে বসে, ডালারা তাঁর তরুণ বয়সের কথা শোনেন এবং ১৯৬০-এর দশকের সেই সাপ্তাহিক আদিবাসী সমাবেশের স্মৃতিচারণ করেন।
তিনি প্রশ্ন করেন, “এখন কোথায় সেই স্থানগুলো, যেখানে আদিবাসী মানুষেরা মিলিত হতে পারে, মিশতে পারে?
পাবের পরিবর্তে নাচ এবং মিলিত হওয়ার জন্য আরও বেশি জায়গার প্রয়োজন। এই ধরনের অনুষ্ঠানে প্রবীণ ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকতে হবে, যা কেবল কোনো বার্ষিক উৎসব বা ইভেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে।”
ডালারার শৈশবের সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি হলো, তাঁর মা তাঁর আত্মীয়স্বজন ও তাঁদের শিশুদের ‘দ্য ব্লক’-এ তাঁদের বাড়িতে ডেকে পাঠাতেন এবং একসঙ্গে বসে ছবি আঁকা ও গান শুনতেন।
রেডফার্ন পার্কে, ১৯৯২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পল কিটিং ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে আদিবাসী মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তা স্বীকার করে ভাষণ দিয়েছিলেন।
২০২৩ সালের গণভোটের আগে আদিবাসী মানুষেরা এখানে আনন্দ ও প্রতিবাদের জন্য একত্রিত হয়েছিল।
২০১৩ সালে, ডালারার মা লিসা রেডফার্ন অল ব্ল্যাকস রাগবি লিগ দলের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ডালারা এই মাঠটিকে রবিবারের ফুটবল খেলার একটি মিলনক্ষেত্র হিসেবে মনে করেন।
ডালারা ইওরা টেফে পড়াশোনা করেছেন।
১৯৮৪ সালে নাট্যকার রবার্ট মেরিটের হাত ধরে এর প্রতিষ্ঠা হয়। তিনিই প্রথম আদিবাসী অস্ট্রেলীয়, যিনি পূর্ণদৈর্ঘ্যের নাটক পেশাদারভাবে তৈরি করেন।
সেখানেই ডালারার সঙ্গে অভিনেত্রী ও নাট্যকার মেগান ওয়াইল্ডিংয়ের পরিচয় হয়।
মেগান তাঁর জন্য ‘কুইনি’ নামের একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যিনি ‘বিগ গার্লস ডোন্ট ক্রাই’-এর তিনজন তরুণীর মধ্যে অন্যতম।
সিডনির নিডা-তে অভিনয়ের ওপর পড়াশোনা করার পর ডালারা তাঁর নতুন নাটকের মাধ্যমে ‘বোনদের গল্প’ এবং ‘শহরের আদিবাসী জীবন’ ফুটিয়ে তুলতে চান।
তিনি রেডফার্ন ছাড়তে চান না।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আদিবাসী মানুষজন অদৃশ্য হয়ে যায়নি; আপনি রেডফার্ন স্ট্রিটে হাঁটলে এখনও আদিবাসী মানুষের দেখা পাবেন।
আমার মনে হয়, এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে রেডফার্ন কতটা বিশেষ, তা অনেকেই বোঝে না।
এটা নিছক কোনো শহরতলী নয়, এর শিকড় অনেক গভীরে।”
‘বিগ গার্লস ডোন্ট ক্রাই’ নাটকটি ৫ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সিডনির বেলভোর সেন্ট থিয়েটারে প্রদর্শিত হবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান