সমুদ্রে ডুবে যাওয়া গ্রামে টিকে থাকতে ম্যানগ্রোভের আশ্রয়!

সমুদ্রের জল বাড়ছে, গ্রাস করছে জনপদ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এই সংকট আজ শুধু একটি দেশের নয়, বরং বিশ্বজুড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় ফেলেছে গভীর প্রভাব।

এই বাস্তবতার সাক্ষী হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের একটি পরিবারের গল্প, যারা প্রকৃতির সঙ্গেই খুঁজে নিয়েছে প্রতিকারের উপায়।

ইন্দোনেশিয়ার জাভা প্রদেশের রেজোসারি সেনিক গ্রামের বাসিন্দা পাজিয়াহ। ৫৪ বছর বয়সী এই নারীর বাড়িটি একসময় ছিল শুকনো ভূমিতে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় এখন সেটি পানির নিচে।

তাঁর প্রতিবেশী অনেক পরিবার ঘরবাড়ি, জমি-জমা হারিয়ে অন্যত্র চলে গেলেও, পাজিয়াহ তাঁর ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চান।

সমুদ্রের নোনা জল সবসময় তাঁর বাড়ির চারপাশ দিয়ে বয়ে যায়, কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি।

পাজিয়াহ জানান, “আমি এখানেই থাকতে চাই, বাড়ির প্রতি আমার ভালোবাসা এখনো অটুট।” বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এখন শুকনো ভূমি, আর ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দেমাক শহর—সেখানে যেতে হয় নৌকায়।

ইন্দোনেশিয়া, যা হাজারো দ্বীপের একটি সমষ্টি, এর বিশাল উপকূলরেখা রয়েছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ভাঙনের শিকার হচ্ছে।

১৯৯২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশটির উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর সমুদ্রের জল প্রায় ৪.২৫ মিলিমিটার করে বেড়েছে।

তবে সম্প্রতি এই বৃদ্ধির হার আরও বেড়েছে বলে জানা গেছে।

ইন্দোনেশিয়ার আবহাওয়া, জলবায়ুবিদ্যা ও ভূ-পদার্থবিদ্যা সংস্থার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কর্মকর্তা কাদরশাহ্‌ বলেছেন, “সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম লক্ষণ।”

তিনি আরও জানান, অনেক ছোট ছোট দ্বীপ এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।

শুধু তাই নয়, ভূগর্ভস্থ জল অতিরিক্ত উত্তোলনের কারণে জাভার উত্তর উপকূলের ভূমি দেবে যাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

এই সমস্যার সমাধানে ইন্দোনেশিয়া সরকার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সমুদ্র বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।

তবে পাজিয়াহ এবং তাঁর পরিবার বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ।

গত ২০ বছর ধরে তিনি প্রতি বছর প্রায় ১৫,০০০ ম্যানগ্রোভ গাছের চারা রোপণ করেছেন।

নীল রঙের একটি প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে তৈরি নৌকায় চড়ে তিনি রোজ সকালে বের হন, এই গাছগুলোর পরিচর্যা করেন এবং নতুন চারা রোপণ করেন।

কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “বন্যার জল ধীরে ধীরে আসে, একসঙ্গে নয়। জল বাড়া শুরু হওয়ার পর আমি অনুভব করলাম, ম্যানগ্রোভ লাগাতে হবে, যা আমার ঘরকে ঝড় ও ঢেউ থেকে রক্ষা করবে।”

পাজিয়াহ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁদের ছেলেদের ধরা মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

তাঁরা জানান, যতদিন পারবেন, তাঁরা এই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন।

একাকিত্বের ভয়কে জয় করে পাজিয়াহ এখন প্রকৃতির সঙ্গেই পথ চলছেন।

ইন্দোনেশিয়ার এই ঘটনা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।

বাংলাদেশের মানুষও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার।

আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়, যা জীবন ও জীবিকার ক্ষতি করে।

এমন পরিস্থিতিতে ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করে উপকূল রক্ষা করা যেতে পারে।

সুন্দরবন সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়ন একটি পরিচিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ।

ইন্দোনেশিয়ার পাজিয়াহ-এর এই লড়াই আমাদের শেখায়, প্রকৃতির সঙ্গেই আমাদের ভবিষ্যৎ, প্রকৃতির সুরক্ষাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *