আতঙ্কে ইন্দোনেশিয়ার মানুষ! রুপির রেকর্ড দর পতন, কী ঘটতে যাচ্ছে?

ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়া: সংকট নাকি অশনি সংকেত?

ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির মুদ্রা রুপিয়াহ’র ক্রমাগত দরপতন। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপিয়াহ’র মূল্য এতটাই কমেছে যে, তা ১৯৯৭-৯৮ সালের এশীয় অর্থনৈতিক সংকট-এর স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রুপিয়াহ’র এই দুর্বলতা দেশটির ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধরনের সতর্কবার্তা।

গত অক্টোবর মাস থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই প্রাবো Subianto-র নেতৃত্ব নিয়ে উদ্বেগের কারণে রুপিয়াহ’র দর প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে। প্রাক্তন এই জেনারেলের অর্থনৈতিক নীতি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারছে না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রুপিয়াহ’র এই দরপতন ১৯৯৮ সালের সংকটের মতোই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, যা সুহার্তোর তিন দশকের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সিঙ্গাপুরের কন্ট্রোল রিস্কস-এর একজন বিশ্লেষক আচমাদ সুকারসোনো আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় যা ঘটছে, তা বর্তমান নেতৃত্বের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর প্রতি বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারী ও বাজারের আস্থার প্রতিফলন।”

গত কয়েক মাস ধরেই রুপিয়াহ’র দর ক্রমাগত কমছে এবং মঙ্গলবার এটি সর্বকালের সর্বনিম্ন ১৬,৮৫০-এ পৌঁছেছে। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হ্যাল হিল মনে করেন, রুপিয়াহ’র এই পতন ইন্দোনেশিয়ার মানুষের জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ১৯৯৮ সালের সংকটে এর ভূমিকা ছিল।

তার মতে, “যদি ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়াহের দর উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, তবে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং তারা আগের সংকটের পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা করে।”

মুদ্রার দর পতনের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, বাণিজ্য ঘাটতি এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা। ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে, প্রেসিডেন্ট প্রাবো-র কিছু নীতি, যেমন – বিনামূল্যে স্কুল-দুপুরের খাবার কর্মসূচি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা দুর্বল করার পরিকল্পনা এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর বিধিনিষেধ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে।

এছাড়াও, প্রাবো’র ২০ বিলিয়ন ডলারের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠন এবং সামরিক কর্মকর্তাদের বেসামরিক পদে নিয়োগের সিদ্ধান্তের কারণেও উদ্বেগ বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত মাসে অর্থমন্ত্রী শ্রী মুুলিয়ানি ইন্দ্রাওয়াতীকে গুজব উড়িয়ে দিতে হয়, যেখানে বলা হয়েছিল যে তিনি বাজারের অস্থিরতার মধ্যে পদত্যাগ করতে পারেন।

ইন্দোনেশিয়া একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে, তেমনই চীন-এর অর্থনৈতিক মন্দা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।

ইন্দোনেশিয়া একটি মধ্যম আয়ের দেশ। ২০২৪ সালে দেশটির মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল প্রায় $৪,৯৬০। যদিও দেশটির জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল, তবে অনেক ইন্দোনেশীয় নাগরিকের জীবনযাত্রার মান কমে গেছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯ সালে যেখানে এই সংখ্যা ছিল ৫৭.৩ মিলিয়ন, সেখানে গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭.৮ মিলিয়নে।

এর প্রধান কারণ হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং কোভিড-১৯-এর প্রভাবকে দায়ী করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, ইন্দোনেশিয়া বর্তমানে ১৯৯৭-৯৮ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের পর সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসের কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধানে মনোযোগ দেওয়া।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *