কিছু সময় পর পর উপবাস কি আপনার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে? নতুন গবেষণা জানুন।
বর্তমান যুগে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে, আর এর সঙ্গে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের ডায়েটের জনপ্রিয়তা। এদের মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত ডায়েট হলো ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ বা কিছু সময় পর পর উপবাস। অনেকের মনে এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে, যেমন – উপবাস করলে কি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কোনো প্রভাব পড়ে? সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাইকোলজিক্যাল বুলেটিন’-এ প্রকাশিত এক গবেষণা জানাচ্ছে, স্বল্প সময়ের জন্য উপবাস করলে (সাধারণত ২৪ ঘণ্টার কম) প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব পড়ে না। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. ডেভিড মোরো। তিনি বলেন, “অনেকে মনে করেন উপবাস করলে কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া বা ভালোভাবে পড়াশোনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে আমাদের গবেষণা দেখাচ্ছে, অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের উপবাস মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না।”
গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, শিশুদের এবং কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে উপবাসের সময় মানসিক কর্মক্ষমতায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। তাই বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর প্রাতঃরাশ করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও, উপবাসের শেষ দিকে অংশগ্রহণকারীদের মানসিক পরীক্ষার ফলাফলে কিছুটা দুর্বলতা দেখা গেছে। গবেষকদের মতে, শরীরে খাদ্যের অভাব সার্কেডিয়ান রিদম বা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দকে প্রভাবিত করতে পারে।
ড. মোরো আরও যোগ করেন, “প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন খাদ্যের অভাব ছিল, তখন আমাদের শরীর এই ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছিল। তবে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা এতে বেশি সংবেদনশীল হতে পারে, কারণ তাদের শরীরে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়।”
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী এবং এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন এমন অনেকে এই গবেষণার ফলাফলকে সমর্থন করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার মেমোরিয়ালকেয়ার সার্জিক্যাল ওয়েট লস সেন্টারের জেনারেল সার্জন ড. মির আলী বলেন, “উপবাস আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে না – এই বিষয়টি অনেককে আশ্বস্ত করবে।”
তবে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ডেবরা সেফার মনে করেন, গবেষণায় স্বল্পমেয়াদী উপবাসের (গড় ১২ ঘণ্টা) প্রভাব বিবেচনা করা হয়েছে। তিনি আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে উপবাস এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬৩টি গবেষণা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে, যেখানে ৩,৪০০ জনের বেশি অংশগ্রহণকারী ছিলেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই ৮ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত উপবাস করেছেন, যার গড় সময় ছিল ১২ ঘণ্টা। গবেষণার ফলাফল বলছে, উপবাস মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি বা অবনতি ঘটায় না। তবে গবেষকরা কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন যা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, উপবাসের শেষের দিকে মানসিক পরীক্ষার ফলাফলে দুর্বলতা দেখা যেতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, নিয়মিত খাবার গ্রহণকারীদের জন্য গ্লাইকোজেন হলো প্রধান শক্তির উৎস। উপবাসের সময় গ্লাইকোজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে, তবে শরীর তখন চর্বি থেকে উৎপাদিত ‘কেটোন বডি’র মতো বিকল্প শক্তি ব্যবহার করতে শুরু করে। গবেষকদের মতে, এই পদ্ধতি খাদ্য সংকটের সময় টিকে থাকতে সাহায্য করে।
ড. সেফার মনে করেন, “মানব শরীর খুবই সহজে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। স্বল্প সময়ের উপবাসে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না।” তবে, উপবাসের সময়কাল, মানসিক পরীক্ষার প্রেক্ষাপট এবং ব্যক্তির বয়স – এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা কিছু সময় পর পর উপবাস হলো এমন একটি খাদ্যাভ্যাস যেখানে খাবার গ্রহণ ও উপবাসের মধ্যে একটি চক্র বজায় থাকে। এই পদ্ধতিতে খাবারের সময়ের উপর জোর দেওয়া হয়, কী খাবার খাওয়া হচ্ছে সেটির উপর নয়। বিভিন্ন ধরনের ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং পদ্ধতি রয়েছে।
উপবাস শরীরের উপর বিভিন্নভাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, এটি শরীরের চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে। ড. আলীর মতে, “উপবাস মূলত শরীরকে ফ্যাট বার্নিং মোডে নিয়ে যায়।” ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ওজন কমাতে সাহায্য করে, কারণ এতে দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণ কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়াও, এটি শরীরের প্রদাহ কমাতে সহায়ক।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। যেমন – ক্ষুধা লাগা, দুর্বলতা এবং অন্যান্য সমস্যা। যাদের খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে বা যারা গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত নাও হতে পারে। তবে, এই ডায়েটে নমনীয়তা রয়েছে। উপবাসের সময় পানি, চা, কফি ও অন্যান্য তরল পান করা যেতে পারে। নিয়মিত ব্যায়ামও চালিয়ে যাওয়া যায়।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করার সময় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা, ব্যায়াম করা এবং পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। ড. আলী উপবাস শুরু করার সময় ধীরে ধীরে শুরু করার পরামর্শ দেন। প্রথমে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা উপবাস করা যেতে পারে, এরপর ধীরে ধীরে তা ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তিনি রাতের খাবারে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও সবজি রাখার পরামর্শ দেন, এবং কার্বোহাইড্রেট কম খাওয়ার কথা বলেন, কারণ কার্বোহাইড্রেট দ্রুত শরীরে শক্তি যোগায় এবং ক্ষুধার উদ্রেক করতে পারে।
স্বাস্থ্য বিষয়ক যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
তথ্য সূত্র: হেলথলাইন