বৈদ্যুতিক রোগ প্রতিরোধের নতুন দিশা: ‘ইনভার্স ভ্যাকসিন’-এর হাত ধরে সুস্থ জীবনের স্বপ্ন।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত, যেখানে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধেই কাজ করে। মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (Multiple sclerosis) ও লুপাসের মতো রোগ থেকে শুরু করে টাইপ ১ ডায়াবেটিস (Type 1 diabetes) এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস—এই রোগগুলোতে শরীরের নিজস্ব কোষগুলোকেই ধ্বংস করতে উদ্যত হয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
বিদ্যমান চিকিৎসাগুলো এই আক্রমণকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে, কিন্তু এর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগীদের জন্য তা বেশ কষ্টকর হয়।
তবে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। গবেষকরা এমন একটি পদ্ধতির ওপর কাজ করছেন যা শরীরের ভুল পথে চালিত প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শুধরে দেবে।
এই চিকিৎসা পদ্ধতি ‘ইনভার্স ভ্যাকসিন’ নামে পরিচিত। প্রচলিত ভ্যাকসিনের (vaccine) মতো এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ানোর পরিবর্তে, নির্দিষ্ট একটি অংশের কার্যকারিতা কমিয়ে আনে।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির (Northwestern University) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশেষজ্ঞ স্টিফেন মিলার (Stephen Miller) এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা এই রোগগুলোর চিকিৎসায় ভারী অস্ত্রের পরিবর্তে সূক্ষ্ম অস্ত্র ব্যবহার করতে চাই।
২০২২ সালে ‘গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি’ জার্নালে প্রকাশিত মিলারের গবেষণাপত্রটি (২০২১ সালের গবেষণা) প্রথম প্রমাণ করে যে, ইনভার্স ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে কার্যকর হতে পারে।
এই গবেষণায় সিলিয়াক ডিজিজ (celiac disease) আক্রান্ত রোগীদের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। সিলিয়াক ডিজিজে গ্লুটেন নামক একটি প্রোটিনের কারণে অন্ত্রের ক্ষতি হয়। গ্লুটেন গম ও অন্যান্য শস্যে পাওয়া যায়।
পরীক্ষায় দেখা যায়, ইনভার্স ভ্যাকসিন গ্রহণকারী রোগীদের অন্ত্রে কোনো ক্ষতি হয়নি, যেখানে অন্য একটি দল (যারা প্লাসিবো গ্রহণ করেছিল) তাদের উপসর্গের অবনতি হয়েছে।
ইনভার্স ভ্যাকসিন তৈরির মূল ধারণা হলো, বিশেষ কিছু সিনথেটিক ন্যানোপার্টিক্যাল ব্যবহার করা, যা রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রোটিন বা অ্যান্টিজেন (antigen)-এর সঙ্গে যুক্ত থাকে।
এই ন্যানোপার্টিক্যালগুলো মানবদেহের মৃত কোষের মতো কাজ করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পুনরায় প্রশিক্ষিত করে। এর ফলে শরীর ন্যানোপার্টিক্যাল ও এর সঙ্গে যুক্ত প্রোটিনকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা বন্ধ করে দেয়।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির (NYU) জৈবপ্রকৌশলী জেফরি হাবেল (Jeffrey Hubbell) বলেন, “এই পদ্ধতি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নতুন করে শিক্ষা দেয়। ফলে এটি বুঝতে পারে যে, কোনো নির্দিষ্ট বস্তুকে আক্রমণ করার প্রয়োজন নেই।
২০২৩ সালে, হাবেল এবং তার সহকর্মীরা ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, এই পদ্ধতি ইঁদুরের শরীরে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের (multiple sclerosis) চিকিৎসায় সফল হয়েছে। মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের ওপর আক্রমণ করে।
হাবেল এবং অন্যান্য গবেষকদের প্রতিষ্ঠিত ‘অ্যানোকিয়ন’ (Anokion) নামক একটি কোম্পানি বর্তমানে সিলিয়াক ডিজিজ ও মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের রোগীদের ওপর ইনভার্স ভ্যাকসিনের প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষা চালাচ্ছে এবং ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।
ক্যালগারি ইউনিভার্সিটির (University of Calgary) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশেষজ্ঞ পেরে সানতামারিয়া (Pere Santamaria) এই আবিষ্কারকে ‘পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি জানান, এই ধরনের সাফল্যের কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
সান্তামারিয়া প্রধানত টাইপ ১ ডায়াবেটিস (type 1 diabetes) নিয়ে কাজ করেন, যেখানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইনসুলিন তৈরি কারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
বর্তমানে তিনি লিভারের রোগ ‘প্রাইমারি বিলিয়ারি কোলাঞ্জাইটিস’ (primary biliary cholangitis – PBC)-এর চিকিৎসায় ইনভার্স ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছেন।
ইনভার্স ভ্যাকসিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হলো এর বহুমাত্রিকতা। এটি বিভিন্ন ধরনের অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় কাজে আসতে পারে।
ইনভার্স ভ্যাকসিন শুধু অটোইমিউন রোগের চিকিৎসাই নয়, অ্যালার্জির (allergy) চিকিৎসাতেও কাজে আসতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের (University of Michigan) গবেষক লনি শিয়া (Lonnie Shea) এবং তার সহকর্মীরা বাদাম ও অন্যান্য অ্যালার্জির ওপর গবেষণা করে সফল হয়েছেন।
ইনভার্স ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা এখনো পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মানুষের ব্যবহারের জন্য এটি প্রস্তুত হতে আরো ৩ থেকে ১০ বছর সময় লাগতে পারে।
যদিও এই চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, গবেষকরা এর সম্ভাবনা নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী।
তথ্য সূত্র: The Guardian