ইরানে ইসরাইলের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির জেরে আতঙ্কে সাধারণ মানুষ, শহর ছাড়ছেন অনেকে।
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনার কারণে ইরানের সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে রাজধানী তেহরানসহ বড় শহরগুলো ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন। ইসরাইল দেশটির পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইরানের ওপর হামলার হুমকি অব্যাহত রাখায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তেহরানের একটি অভিজাত এলাকা সা’আদাতাবাদে বসবাসকারী এক ব্যক্তি সিএনএনকে জানান, তারা রাতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ শুনেছেন, যা তাদের অ্যাপার্টমেন্ট পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছে। ওই এলাকার অন্যান্য বাসিন্দার মতো তিনিও নাম প্রকাশ করতে চাননি, কারণ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
ওই ব্যক্তি আরও জানান, একটি ভবনে আগুন লাগার পর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে বাসিন্দারা দ্রুত নিচে নেমে আসে। এসময় শিশুদের শান্ত রাখতে পরিবারগুলোকে বেশ বেগ পেতে হয়।
ইরানের রাজধানী তেহরানে আধুনিক বোমা হামলার আশ্রয়কেন্দ্র নেই। এখানকার বাসিন্দাদের জন্য ১৯৮০ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় নির্মিত কিছু পুরনো আশ্রয়কেন্দ্র এবং বেজমেন্ট ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তেহরান সিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেহদি চামরান সাংবাদিকদের বলেন, “সংকটময় পরিস্থিতিতে” মেট্রোকে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে “সিস্টেম বন্ধ” রাখতে হবে। কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, রোববার রাত থেকে তেহরানের মেট্রো পরিষেবা সাধারণ মানুষের আশ্রয় লাভের জন্য ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে। এছাড়া, স্কুল এবং মসজিদগুলোও খোলা রাখা হবে।
সা’আদাতাবাদের ওই বাসিন্দা জানান, এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিরা এখানকার ভীতিপূর্ণ পরিবেশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধে ইরাকি বাহিনী ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ চালিয়েছিল।
এদিকে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ইরানের আবাসিক এলাকাগুলোতে হামলার মাধ্যমে “সীমারেখা অতিক্রম করেছে” বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, এর ফলে তেহরানও একই ধরনের প্রতিশোধ নিতে পারে।
তেহরানের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “আমরা ইরান সরকারের প্রতি সমর্থন জানাই না, তবে ইসরাইলের এই ধরনের হামলাকে সমর্থন করি না। ইসরাইল যদি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও সামরিক সক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়, তবে তাদের উচিত সেই স্থানগুলোতে হামলা চালানো, আবাসিক এলাকায় নয়। তাহলে গাজায় যা ঘটছে, তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।”
অন্যদিকে, ইসরাইলের হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এবং সেখানকার প্রায় সবাই বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
তেহরানে যারা এখনো আছেন, তারা যুদ্ধের আশঙ্কা সত্ত্বেও দৈনন্দিন জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। মুদি দোকানগুলোতে এখনো প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে এবং পূর্বনির্ধারিত কিছু অনুষ্ঠানও চলছে। তবে সংঘাতের শঙ্কা সবসময় তাদের মনে রয়েছে।
গাড়ির জন্য পেট্রোল পাম্পগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে এবং প্রত্যেককে ২৫ লিটারের বেশি পেট্রোল কিনতে দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া, কিছু এটিএম বুথে নগদ টাকা তোলার পরিমাণও সীমিত করা হয়েছে।
আতঙ্কের কারণে রাজধানী ছেড়ে অনেকে উত্তরাঞ্চলের দিকে যাচ্ছেন, যেখানে ক্যাস্পিয়ান সাগরের কাছাকাছি এলাকা তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ এবং জনবসতি কম। তবে সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রাস্তাঘাটে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবার তেহরান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছে দুটি ছোট শিশু এবং বৃদ্ধ বাবা-মা। তারা আশঙ্কা করছেন, সরকার সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সামরিক কর্মকর্তাদের জনবহুল এলাকায় রেখেছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
ওই পরিবারের এক কর্তা বলেন, “আমি আমার ঘর ছাড়তে চাই না, তবে আমি আমার সন্তানদের এই পরিস্থিতিতে ফেলতে পারি না। আমি আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের মধ্যে হামলা বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ করবে।”
ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর শিরাজেও পেট্রোলের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। সেখানকার বাসিন্দারা খাদ্য, জল এবং শিশুদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুদ করছেন। শহরের বিভিন্ন স্থানে পরিবারগুলোকে তাদের গাড়িতে করে লাগেজ ও পানির বোতল নিয়ে গ্রাম অঞ্চলের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তেহরানে রাতের বেলা এখন বেশ নীরবতা বিরাজ করছে। অনেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে এবং অনেকে শহর ছেড়ে চলে গেছেন অথবা কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন।
হোয়াইট হাউস ও ইসরাইলি কর্মকর্তাদের মতে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের অভিযান “কয়েক দিন নয়, কয়েক সপ্তাহ” পর্যন্ত চলতে পারে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, তিনি “আয়াতের শাসনামলের প্রতিটি স্থান ও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানবেন।”
অন্যদিকে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর কাছাকাছি বসবাসকারী ইরানি নাগরিকদের জন্য “জরুরি” সতর্কবার্তা জারি করেছে এবং তাদের এলাকা ছাড়তে বলেছে।
ইসরাইলের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ইরানের জনগণের প্রতি বিরল এক ভাষণে নেতানিয়াহু ইরানি নাগরিকদের “তাদের কণ্ঠস্বর” তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “সময় এসেছে ইরানি জনগণ তাদের পতাকা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।”
তবে ইসরাইলের এই আহ্বানে খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। সিএনএন এর সঙ্গে কথা বলা অনেক ইরানি নেতানিয়াহুর এই আহ্বানে সমর্থন জানাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, “ইসরাইল আমাদের দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে খাটো করে দেখছে। তারা যদি আমাদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়, আমাদের শিশুদের হত্যা করে, তবে আমরা রাস্তায় নামব—এমনটা ভাবাটা খুবই হতাশাজনক। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচতে চাই, তা আমরা এই সরকারকে পছন্দ করি বা না করি।”
আরেকজন ২৮ বছর বয়সী নারী বলেন, “আমি কি চাই না এই সরকারের পতন হোক? অবশ্যই চাই। আমি কি চাই আমার শহর অন্য কোনো স্বৈরশাসকের দ্বারা বোমাবর্ষণ করা হোক? অবশ্যই না।”
ইরান হুমকি দিয়েছে, ইসরাইল যদি তাদের আগ্রাসন অব্যাহত রাখে, তবে তারা প্রতিশোধমূলক হামলা আরও তীব্র করবে।
ইসরাইল সরকারের দাবি, রোববার রাতে ইরান থেকে ২০০টির বেশি রকেট হামলা চালানো হয়েছে। এতে ইসরাইলে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজন শিশু রয়েছে। ইরানের সরকারি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় দেশটির ডজন খানেক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। তবে ইরানের কর্তৃপক্ষ এখনো হতাহতের সংখ্যা ঘোষণা করেনি।
তথ্য সূত্র: সিএনএন