ইরানের পরমাণু কেন্দ্র: ভয়াবহ হামলার কারণ?

ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো: উত্তেজনার পারদ যখন ঊর্ধ্বমুখী

সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বাড়ছে। ইসরায়েল সম্প্রতি ইরানের কিছু সামরিক ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। তাদের দাবি, ইরান দ্রুতগতিতে পরমাণু বোমা তৈরির দিকে যাচ্ছে, যা তাদের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ।

যদিও ইরান বরাবরই বলে আসছে যে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) তাদের সঙ্গে সহযোগিতা না করার কারণে ইরানের নিন্দা করেছে। এর পরেই ইরান নতুন একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে।

আসুন, ইরানের প্রধান কিছু পরমাণু স্থাপনার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাক:

**নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্র (Natanz Enrichment Facility):** তেহরানের প্রায় ২২০ কিলোমিটার (প্রায় ১৩৭ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র।

এই কেন্দ্রের কিছু অংশ মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে এটি রক্ষা করা যায়। এখানে বিভিন্ন ‘ক্যাসকেড’ বা একগুচ্ছ সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করা হয়, যা দ্রুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করে।

নাতাঞ্জ-এর কাছে ‘কোহ-ই-কোলাং গাজ লা’ নামক একটি পাহাড়ের নিচেও তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই কেন্দ্রটি অতীতে ইসরায়েল ও আমেরিকার তৈরি ‘স্টাক্সনেট’ ভাইরাসের শিকার হয়েছিল, যা ইরানের সেন্ট্রিফিউজগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

এছাড়া, এখানে একাধিকবার অন্তর্ঘাতমূলক হামলাও হয়েছে, যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়।

**ফোরদো পরমাণু কেন্দ্র (Fordo Enrichment Facility):** তেহরান থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (প্রায় ৬২ মাইল) দূরে অবস্থিত ফোরদো পরমাণু কেন্দ্রটিও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সঙ্গে জড়িত।

এটি নাতাঞ্জের চেয়ে ছোট হলেও এখানেও সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করা হয়। এই কেন্দ্রটি একটি পাহাড়ের নিচে তৈরি করা হয়েছে এবং বিমান হামলা প্রতিরোধের জন্য এখানে বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও মোতায়েন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সম্ভবত ২০০৭ সাল থেকে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এর অস্তিত্ব জানার পরেই ইরান ২০০৯ সালে জাতিসংঘের কাছে বিষয়টি জানায়।

**বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (Bushehr Nuclear Power Plant):** ইরানের একমাত্র বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পারস্য উপসাগরের তীরে বুশেহরে অবস্থিত।

এটি তেহরান থেকে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার (প্রায় ৪৬৫ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। ১৯৭০-এর দশকে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান-ইরাক যুদ্ধে এটি কয়েকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে রাশিয়া এই কেন্দ্রের নির্মাণ সম্পন্ন করে। বুশেহরে রাশিয়ার সরবরাহ করা ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয় এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) এটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে।

এখানে আরও দুটি রিঅ্যাক্টর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

**আরাক ভারী জল রিঅ্যাক্টর (Arak Heavy Water Reactor):** তেহরান থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার (প্রায় ১৫৫ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত আরাক ভারী জল রিঅ্যাক্টরটি পারমাণবিক চুল্লিকে শীতল রাখতে সহায়তা করে।

তবে এর উপজাত হিসেবে প্লুটোনিয়াম তৈরি হয়, যা পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি অনুযায়ী, ইরান এই কেন্দ্রের নকশা পরিবর্তনের মাধ্যমে অস্ত্র তৈরির আশঙ্কা কমাতে রাজি হয়েছিল।

**ইস্পাহান নিউক্লিয়ার টেকনোলজি সেন্টার (Isfahan Nuclear Technology Center):** তেহরান থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার (প্রায় ২১৮ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ইস্পাহান কেন্দ্রে হাজার হাজার পরমাণু বিজ্ঞানী কাজ করেন।

এখানে তিনটি চীনা গবেষণা চুল্লি এবং দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণাগারও রয়েছে।

**তেহরান গবেষণা রিঅ্যাক্টর (Tehran Research Reactor):** ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার সদর দফতরে অবস্থিত তেহরান গবেষণা রিঅ্যাক্টরটি দেশটির পরমাণু কর্মসূচির তদারকি করে।

১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই রিঅ্যাক্টরটি তৈরি করা হয়েছিল। প্রথমে এখানে উচ্চ-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হলেও পরে এটিকে নিম্ন-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।

বর্তমানে ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে রাজি ছিল, যদি তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করে।

কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে উত্তেজনা কমিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা যায়।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *