ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা: পরমাণু চুক্তির ফাঁদে ট্রাম্পকে ফেলার চেষ্টা?

ইরানের পারমাণবিক চুক্তি: ট্রাম্পকে ‘লক্ষ কোটি ডলারের’ হাতছানি, আমেরিকার কি লাভ হবে?

ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি করার চেষ্টা করছে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দের ব্যক্তিত্ব—একজন সফল ব্যবসায়ী—এর প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। তেহরানের কর্মকর্তারা ট্রাম্পের যুদ্ধ-বিরোধী এবং ব্যবসা-বান্ধব ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তিকে এমনভাবে তুলে ধরছেন, যেন এর মাধ্যমে ট্রাম্পের ‘আমেরিকাকে আবার ধনী করার’ প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে।

তাদের যুক্তি হলো, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ আমেরিকার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যেখানে কূটনীতি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দ্বার উন্মোচন করতে পারে। গত মাসে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি উল্লেখ করেছেন, “অনেক পশ্চিমা দেশ ইরানকে অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি বন্ধ দেশ হিসেবে চিত্রিত করে।

কিন্তু সত্যি হলো, আমরা সারা বিশ্ব থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। আমাদের অর্থনীতিতে প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে যে লক্ষ কোটি ডলারের সুযোগ তৈরি হয়, তা থেকে আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে দূরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও কংগ্রেসের প্রতিবন্ধকতা, ইরান নয়।”

ইরানি কর্মকর্তারা একটি সম্ভাব্য চুক্তিকে ট্রাম্পের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি ব্যবসায়িক সুযোগ হিসেবে তুলে ধরছেন। এর মধ্যে রয়েছে শুল্কের ওপর জোর দেওয়া এবং অর্থনৈতিক পারস্পরিকতার দাবি। ‘বোর্স অ্যান্ড বাজার ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান নির্বাহী এসফান্দিয়ার বাতমাংঘেলিদজ এই মন্তব্য করেছেন।

তার মতে, “তারা দেখছে ট্রাম্প একজন ডিলমেকার হিসেবে পরিচিত হতে চান… তারা স্পষ্টতই বুঝতে পারছে, ট্রাম্প এমন চুক্তি চাইছেন যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য লাভজনক হবে।”

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ওমানের মধ্যস্থতায় তিন দফা আলোচনা হয়েছে। সবশেষ আলোচনায় সম্ভাব্য চুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়ে কারিগরি আলোচনাও হয়েছে। উভয় পক্ষই ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে।

ট্রাম্পের হিসাব মেলানোর চেষ্টা

ট্রাম্প ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিকে (যা ওবামা প্রশাসনের সময় সম্পাদিত হয়েছিল) যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে একাধিকবার সমালোচনা করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে একে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ এবং একতরফা চুক্তিগুলোর একটি’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

ঐ চুক্তিতে মূলত গৌণ নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা হয়েছিল, যা ছিল ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করা অ-মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত জরিমানা। সরাসরি মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করতে বাধা দেওয়া প্রধান নিষেধাজ্ঞাগুলো বহাল ছিল।

ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলো ইরানে পুনরায় প্রবেশ করতে পারলেও, মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য সেই সুযোগ সীমিত ছিল।

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে খুব কম সংখ্যক মার্কিন ও বিদেশি কোম্পানি ইরানে ব্যবসা করে। এমনকি ২০১৫ সালের চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেও অনেক পশ্চিমা কোম্পানি সেখানে ব্যবসা করতে দ্বিধা বোধ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ সাধারণত মানবিক সহায়তার জন্য বিশেষ লাইসেন্স দিতে পারে, তবে অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখনো সীমিত।

ইরান সম্ভবত ট্রাম্পের হিসাব পরিবর্তনের চেষ্টা করছে, যাতে একটি লাভজনক চুক্তির চিত্র তুলে ধরা যায়। এমনকি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশটির মূল্যবান পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচির প্রবেশাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন, যা কিছু মার্কিন কর্মকর্তার মতে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সম্মানের প্রতীক।

আরাকচি সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হলো কমপক্ষে আরও ১৯টি পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করা, যার অর্থ হলো কয়েক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি এখানে সম্ভব।” তিনি আরও যুক্তি দেখান, ইরানের বাজার এত বড় যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল পারমাণবিক শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক হতে পারে।

বাজার গবেষণা সংস্থা ‘মর্ভর ইন্টেলিজেন্স’-এর তথ্যমতে, পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যবসার জন্য ইরান একটি বিশাল বাজার, যেখানে প্রায় ৯ কোটি ৬ লক্ষ মানুষের বসবাস এবং তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে।

২০১৫ সালের চুক্তি স্বাক্ষরের পর ‘ম্যাককিনসে গ্লোবাল রিসার্চ’-এর অনুমান ছিল, যদি ইরান কাঠামোগত সংস্কার করে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে, তবে চুক্তি কার্যকর হওয়ার ২০ বছরের মধ্যে দেশটির জিডিপি ১ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং ৯০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।

২০২৪ সালে ইরানের অর্থনীতিতে ৪৩৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদিত হয়েছে। তবে স্থানীয় দাম ও জীবনযাত্রার ব্যয় সমন্বয় করলে (যা ক্রয়ক্ষমতা সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) নামে পরিচিত), ইরানের জিডিপি ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়।

এই দুই সংখ্যার মধ্যে বড় ব্যবধানটি হলো দুর্বল মুদ্রা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বাইরের বিশ্বে ইরানের অর্থনীতির ছোট আকার।

ভিয়েনা-ভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা ‘ইউরেশিয়ান নেক্সাস পার্টনার্স’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজান খাজেহপুর বলছেন, এই বিশাল সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এই ব্যবধান পূরণ করতে এবং এর থেকে উপকৃত হতে পারে।

মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য এই সম্ভাবনা লোভনীয় হতে পারে, তবে অতীতের অভিজ্ঞতা ও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ইরানে ব্যবসা করা সহজ হবে না। এমনকি নতুন পারমাণবিক চুক্তি হলেও, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবসার দরজা খুলে দেবে না।

আইআরজিসির অর্থনৈতিক প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ইরানের ওপর দুই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে: পারমাণবিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) একটি অভিজাত আধা-সামরিক বাহিনী, যা দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িত এবং এটিকে একটি বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যদি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলমান আলোচনা সফল হয়, তবে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞাগুলো সম্ভবত বহাল থাকবে। এর মানে হলো, কিছু খাতে ব্যবসা করার জন্য মার্কিন কোম্পানিগুলোকে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারির ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিসের (ওএফএসি) কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।

গত কয়েক বছরে আইআরজিসি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যা সরকারের সমান্তরালে কাজ করে এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আগের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার পর ইরানের অর্থনীতিতে আইআরজিসির ভূমিকা আরও বেড়েছে, যা মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য প্রবেশ করা আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

বিদেশি কোম্পানিগুলো সেখানে ব্যবসা করতে দ্বিধা বোধ করায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ‘প্রতিরোধী অর্থনীতি’র পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছেন। এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো স্বনির্ভরতা অর্জন এবং বিদেশি আমদানি ও বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। আইআরজিসি নির্মাণ, ব্যাংকিং, টেলিযোগাযোগ ও তেলসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ভূমিকা বাড়িয়ে এই শূন্যতা পূরণ করছে।

খাজেহপুর, যিনি আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে ইরান সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন, বলেন, “অর্থনৈতিক খেলোয়াড়দের মালিকানা সরকার থেকে সরে এসে আধা-রাষ্ট্রীয় সত্তাগুলোর দিকে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু আধা-রাষ্ট্রীয় সত্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোকে তাদের অংশীদারিত্বের কৌশলগুলোর বিভিন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, দুর্নীতি এবং “ইরানি ব্যবসায়িক সংস্কৃতির অস্পষ্টতা” দেশটিতে ব্যবসা করাকে জটিল করে তুলেছে।

ব্যবসার বাধা দূর করা

২০১৫ সালের চুক্তি স্বাক্ষরের পর বোয়িং, টোটাল, পিয়োজিও ও নেসলের মতো পশ্চিমা কোম্পানিগুলো ইরানে ব্যবসা শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, বোয়িং ওএফএসি থেকে লাইসেন্স পাওয়ার পর ইরান এয়ারকে ৮০টি বিমান বিক্রির জন্য ১৬ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি চূড়ান্ত করে। কিন্তু ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মার্কিন সরকার এই লাইসেন্স বাতিল করে, ফলে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়।

যদি এই বাধাগুলো অতিক্রম করা যায়, তবে বাণিজ্য পুনরায় শুরু হতে পারে, বিশেষ করে বোয়িং চুক্তির পুনরুজ্জীবন সম্ভব হতে পারে। খাজেহপুর আরও বলেছেন, তেল ও গ্যাসের পাশাপাশি ইরান অংশীদারদের জন্য খনিজ সম্পদ (দুর্লভ ধাতুসহ), ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতি এবং শিক্ষিত শ্রমিক সরবরাহ করতে পারে।

এসফান্দিয়ার বাতমাংঘেলিদজ বলেছেন, আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে ইরানে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার একটি উপায় হলো ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিতে প্রবর্তিত একটি কৌশল অনুসরণ করা: এর মাধ্যমে মার্কিন কোম্পানিগুলোর অ-মার্কিন সহযোগী সংস্থাগুলোকে কঠোর শর্তে ইরানে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র উপসাগরীয় দেশগুলো ইরান পারমাণবিক চুক্তির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে এবং ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে জড়িত হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আগের চুক্তির সময় তারা ইসলামিক রিপাবলিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। ইরানের প্রধান আলোচক আব্বাস আরাকচি আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে আরব প্রতিবেশীদের অবহিত করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন।

বাতমাংঘেলিদজ আরও যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় দেশগুলোর মাধ্যমে ইরানের বাজারে পরোক্ষভাবে প্রবেশ করতে পারে, যেখানে অনেক আমেরিকান কোম্পানির আঞ্চলিক সদর দপ্তর রয়েছে।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, কোনো নতুন চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকার কারণে—বিশেষ করে ট্রাম্প ২০১৫ সালের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর—যদি ব্যবসায়ীরা দ্বিধা বোধ করে, তবে এর কোনো কিছুই সম্ভব হবে না।

বাতমাংঘেলিদজ বলেন, “২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পরও, এমন অনেক উপায় আছে যা ব্যবহার করে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি করা যেতে পারে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “যদি উভয় পক্ষ এই চুক্তির এমন দিকগুলো তৈরি করতে আগ্রহী হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করবে, তবে অনেক কিছুই করা যেতে পারে। সবশেষে, ইরানে এখনো একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে যারা আমদানি করা পণ্য পেতে চায় এবং আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলো কিনতে পছন্দ করবে।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *