পরমাণু চুক্তি: ইরানের শেষ অস্ত্র হারানোর শঙ্কা!

ইরানের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তেহরান এখনো সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।

ইরানের পক্ষ থেকে এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা আলোচনায় বসলে কোনোঠাসা হয়ে পড়বে কিনা।

খবরটি প্রকাশ করেছে সিএনএন।

খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্প সম্প্রতি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেইকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে নতুন একটি পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং দুই মাসের মধ্যে একটি সমঝোতায় আসার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাঠানো ওই চিঠিতে ‘হুমকি’ ও ‘সুযোগ’ দুটো দিকই ছিল বলে জানা গেছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্বাস আরাকচি জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই তারা এর জবাব দেবেন।

জানা যায়, ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ গত সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠিটি হস্তান্তর করেন। এরপর আমিরাতের পক্ষ থেকে সেটি পৌঁছে দেওয়া হয় ইরানের কাছে।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে উইটকফ জানান, চিঠিতে মূলত শান্তির বার্তা ছিল। সেখানে বলা হয়, কোনো সামরিক পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই, বরং আলোচনার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি দূর করা যেতে পারে।

সেই সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে একটি ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম তৈরির কথাও উল্লেখ করা হয়।

মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ এক সাক্ষাৎকারে জানান, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালিয়েছে।

এটি ছিল ইরানের জন্য একটি সতর্কবার্তা। তেহরান যদি সহযোগিতা করতে রাজি না হয়, তাহলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।

বর্তমানে ইরানের অর্থনীতি দুর্বল এবং আঞ্চলিক প্রভাবও কমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা মনে করছেন, তেহরানকে আলোচনায় বসাতে চাপ প্রয়োগের এটিই উপযুক্ত সময়।

অর্থনৈতিক চাপ বাড়িয়ে এবং সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দিয়ে তারা ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি এত সহজ নাও হতে পারে। ইরান সহজে দুর্বল হিসেবে পরিচিত হতে চায় না এবং ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসতে নারাজ।

লন্ডনের চ্যাথাম হাউজ থিংক ট্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, “এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বেশ জটিল। এখানে ভুল বোঝাবুঝির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং ইরান সামরিক হামলার শিকার হতে পারে।”

ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য হলো, আলোচনার টেবিলে বসার মতো কোনো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।

তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র আবারও চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে, যেমনটা তারা সাত বছর আগে করেছিল।

ইরান মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে আলোচনা ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী আরাকচি জানিয়েছেন, চাপ ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থেকে তারা কোনো আলোচনায় বসবে না।

আলোচনা হতে হবে ‘সমান অবস্থানে’ থেকে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প ইরানের ওপর আরো বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন এবং সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দিতে পারেন।

তবে ইরানের জন্য আত্মসমর্পণ করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট তrita পার্সি বলেন, “ইরানীরা ট্রাম্পের এই ধারণা ভাঙতে চাইছে যে, তারা এতটাই দুর্বল যে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।”

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তারা কারও কাছে মাথা নত করবে না।

তিনি আরও বলেন, “আমি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসব না। আপনারা যা খুশি তাই করুন।”

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার শর্তে এই চুক্তির মাধ্যমে তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা ছিল।

জানুয়ারিতে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সতর্ক করে বলেন, ইরান দ্রুতগতিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।

তারা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধকরণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইরানের গভীর আস্থার অভাব রয়েছে। ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসতে না চাওয়ার এটি একটি প্রধান কারণ।

তেহরানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের আচরণ তাদের হতাশ করেছে। সম্প্রতি ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভেন্সের মধ্যে জেলেনস্কিকে নিয়ে একটি বিতর্ক হয়।

ইরানের মিডিয়াতে পেজেশকিয়ানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “জেলেনস্কির সঙ্গে আপনারা যা করেছেন, তাতে আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত।”

ইরানের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের মিত্রদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে, তাহলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তারা কতটা রাখবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

আয়াতুল্লাহ খামেনেই এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ট্রাম্প আলোচনার কথা বলে আসলে জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।

ভাকিলের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের উভয় পক্ষের জন্যই এখন একটি সমঝোতায় আসা দরকার।

কারণ, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা কমে যাবে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *