ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ইতালির রাজধানী রোমে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরুর প্রাক্কালে তেহরান থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের কারণে একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে। খবর: সিএনএন।
জানা গেছে, শুক্রবার (জানুয়ারি মাসের কোনো একটি তারিখ) থেকে শুরু হওয়া বৈঠকে ওয়াশিংটন চাইছে, ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করুক। কিন্তু ইরানের কর্মকর্তারা বলছেন, এমনটা হলে আলোচনা ভেস্তে যেতে পারে।
বৈঠকে ইরানের অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ অবস্থানটা বুঝতে চাইছে। কারণ তেহরান মনে করছে, কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
বৈঠকে যোগদানের আগে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘চুক্তি হওয়ার পথ কঠিন কিছু নয়। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ হলে আমাদের চুক্তি হবে। আর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করলে, কোনো চুক্তি হবে না।’
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইরান যেন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করে। তাদের যুক্তি, এর ফলে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি সহজ হবে। যদিও ইরান বলছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং তারা চুক্তির অংশ হিসেবে অস্ত্র তৈরির উপযুক্ত পর্যায়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করবে না।
বৃহস্পতিবার (জানুয়ারীর কোনো একটি তারিখ) ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়, আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের জন্য তারা তাদের কার্যক্রম আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণে রাজি। কিন্তু ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ পরমাণু শক্তি অর্জনের অধিকার তারা ছাড়তে নারাজ।
আলোচনা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, তবে তারা চাইছে ইরান যেন পরমাণু কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
অতীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, তারা হয়তো ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অনুমতি দেবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তারা তাদের অবস্থান কঠোর করেছে। এখন তারা কোনো ধরনের সমৃদ্ধকরণ চায় না।
ইরানের কর্মকর্তারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠোর অবস্থানের কারণে চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কারণ ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ তাদের আলোচনার প্রধান শর্ত।
ইরানের সূত্রগুলো বলছে, তেহরান এখন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় আন্তরিকতা নিয়ে সন্দিহান। তাদের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতি এবং আলোচনার ধরন দেখে তেহরানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ইরানের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র জানে যে, তাদের ‘শূন্য সমৃদ্ধকরণ’ প্রস্তাব ইরান গ্রহণ করবে না। এরপরও তারা যদি এই বিষয়ে অনড় থাকে, তাহলে এটি প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কোনো চুক্তি চায় না এবং আলোচনার মাধ্যমে তারা কেবল চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে।’
সূত্রগুলো আরও বলছে, শুরুতে ইরানের কিছু কর্মকর্তা মনে করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘উইন-উইন’ সমাধানে আসতে পারে। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে ধারণা জন্মেছে, ট্রাম্প প্রশাসন আলোচনার মাধ্যমে অচলাবস্থা তৈরি করতে চাইছে।
আলোচনা টেবিলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কেউই থাকতে না চাইলেও, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের কারণে আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সম্ভবত খুব বেশি দিন এই আনুষ্ঠানিক বৈঠক চলবে না।
ইরান মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের ইরান-বিরোধী কঠোর অবস্থানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির যে চেষ্টা করা হচ্ছে, তা গুরুত্বহীন। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রস্তাবগুলো আসলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি করা হচ্ছে, যিনি কোনো ধরনের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের বিরোধী।
এদিকে, শুক্রবার (জানুয়ারীর কোনো একটি তারিখ) রোমে ইরানের প্রতিনিধিরা জানতে চাইবেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে কিনা। সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো ছাড় দিতে রাজি না হয়, তাহলে তেহরান আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।
আলোচনা চললেও, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং যুদ্ধের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
বুধবার (জানুয়ারীর কোনো একটি তারিখ) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করেছে, ইরানের নির্মাণখাত সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পোরেশন (আইআরজিসি)-এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেই কারণে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়ানো হবে। এছাড়াও, তারা ১০টি কৌশলগত উপাদানের তালিকা করেছে, যা ইরান তাদের পারমাণবিক, সামরিক বা ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে ব্যবহার করছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, ‘এই পদক্ষেপের মাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আইআরজিসি-র নিয়ন্ত্রণে থাকা ইরানের নির্মাণখাতের জন্য কৌশলগত উপাদান সংগ্রহ এবং তাদের বিস্তার কর্মসূচি বন্ধ করার আরও বেশি ক্ষমতা আসবে।’
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ ‘অন্যায় ও অমানবিক’। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আমাদের জনগণের মধ্যে এই ধারণা আরও দৃঢ় করছে যে, তারা ইরানের উন্নতি ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এই নিষেধাজ্ঞা, যা ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার পঞ্চম রাউন্ড শুরুর প্রাক্কালে ঘোষণা করা হয়েছে, তা আলোচনার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে।’
তথ্য সূত্র: সিএনএন