ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা: পরমাণু সংকট সমাধানে নতুন মোড়?

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন, ওমানে মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে তাদের পরোক্ষ আলোচনা হতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এই প্রথম এমন আলোচনা হতে যাচ্ছে, যেখানে তেহরানের দ্রুত পরমাণু কর্মসূচি বন্ধের চেষ্টা করা হবে।

আলজেরিয়া থেকে ইরানের সরকারি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্বাস আরাগচি জানান, আলোচনা সম্ভবত পরোক্ষভাবে হবে, যেখানে ওমানের মধ্যস্থতাকারীরা দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। যদিও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার এই আলোচনাকে সরাসরি আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, বাইডেন প্রশাসনের সময়ে হওয়া বহু পরোক্ষ আলোচনা কোনো ফলপ্রসূ ফলাফল আনতে পারেনি। বর্তমানে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি একটি পদক্ষেপ।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়ই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে সামরিক হামলার হুমকি দিয়েছে। অন্যদিকে, তেহরানের কর্মকর্তারাও পরমাণু বোমা তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন।

আরাগচি আরও বলেন, “আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার এবং নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রত্যাহার করা। অন্য পক্ষ যদি আন্তরিক হয়, তবে এটি সম্ভব।

আলোচনার পদ্ধতি—সরাসরি হোক বা পরোক্ষ—তাতে কিছু যায় আসে না। আপাতত, আমরা পরোক্ষ পদ্ধতিতেই আগ্রহী এবং সরাসরি আলোচনার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।”

আরাগচির এই বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলেছে যে, ভবিষ্যতে ইরান সম্ভবত সরাসরি আলোচনাতেও বসতে পারে। ওবামা প্রশাসনের পর এমন কোনো সরাসরি আলোচনা হয়নি।

তবে, মার্কিন পক্ষ থেকে উইটকফ যে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়নি।

আলোচনার খবরে ইরানের অর্থনীতির উন্নতি : আলোচনার খবর প্রকাশ্যে আসার পর ইরানের দুর্বল অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।

দেশটির মুদ্রা রিয়ালের দর মঙ্গলবার কিছুটা বেড়েছে। এক ডলারের বিপরীতে রিয়ালের দাম ১ মিলিয়নের বেশি থেকে কমে ৯ লক্ষ ৯০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া, তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জেও প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে আসার পর এই সংকট আরও বাড়ে।

২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির সময়, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং মজুত উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছিল।

তখন এক ডলারের বিপরীতে রিয়ালের দাম ছিল ৩২ হাজার।

অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে জনগণের সঞ্চয় কমে গেছে, ফলে সাধারণ ইরানিরা এখন কঠিন মুদ্রা, সোনা, গাড়ি এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ধরে রাখতে চাইছে।

অনেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি অথবা দ্রুত ধনী হওয়ার নানা স্কিমের দিকে ঝুঁকছে।

ট্রাম্পের চিঠির সূত্রপাত : শনিবার এই আলোচনার সূত্রপাত হয়, যখন ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেইকে একটি চিঠি লেখেন এবং তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন।

ফেব্রুয়ারিতে খামেনি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনাকে ‘বুদ্ধিহীন, জ্ঞানী বা সম্মানজনক নয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।

এদিকে, ট্রাম্প ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তীব্র বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছেন।

তেহরানের স্বঘোষিত ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ শেষ শক্তি হিসেবে হুতি বিদ্রোহীরাই বর্তমানে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণের ক্ষমতা রাখে।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা যায়, বিশেষ করে ২০২০ সালে বাগদাদে ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যার পর।

মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ইরান থেকে ট্রাম্পকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

তবে, ইরান এখন ভিন্ন পথে হাঁটতে পারে।

ইরানের একটি কট্টরপন্থী দৈনিক ‘কায়হান’ শনিবার একটি নিবন্ধে সতর্ক করে লিখেছিল, ‘শহীদ সোলেইমানির রক্তের প্রতিশোধ হিসেবে ট্রাম্পের শূন্য মাথায় কয়েকটি গুলি চালানো হবে।’

পরে, ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রণালয়ের প্রেস সুপারভাইজরি বোর্ড দৈনিকটিকে এই নিবন্ধের জন্য সতর্ক করে এবং পত্রিকাটি এটিকে ব্যঙ্গাত্মক হিসেবে বর্ণনা করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সরাসরি আলোচনার পরিকল্পনার বিষয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, মস্কো এই আলোচনাকে স্বাগত জানায়।

তিনি আরও বলেন, “আমরা ইরানের পরমাণু ইস্যু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের পক্ষে।

আমরা জানি, ওমানে সরাসরি এবং পরোক্ষ কিছু যোগাযোগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং আমরা অবশ্যই এটিকে স্বাগত জানাই, কারণ এটি ইরানের চারপাশের উত্তেজনা কমাতে পারে।”

পেসকভের এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ট্রাম্প রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি আলোচনা করার চেষ্টা করছেন, যা সৌদি আরবেও অনুষ্ঠিত হতে পারে।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার মস্কোতে ইরান, চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের মধ্যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *