গাজাবাসীদের বিতাড়নের ইসরায়েলি নীলনকশা! ক্ষোভ তুঙ্গে

গাজাবাসীকে অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার বিতর্কিত প্রস্তাব অনুমোদন করলো ইসরায়েল।

গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনি নাগরিকদের অন্য দেশে স্বেচ্ছায় সরিয়ে নেওয়ার একটি বিতর্কিত প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা। এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে অনেকে একে জাতিগত নিধনের শামিল হিসেবে অভিহিত করেছেন।

রবিবার (স্থানীয় সময়) ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ জানান, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজের প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজার যে বাসিন্দারা তৃতীয় কোনো দেশে যেতে আগ্রহী, তাদের জন্য একটি ‘স্বেচ্ছায় স্থানান্তরের’ ব্যবস্থা করতে নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা রাজি হয়েছে। এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির মিল রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

অতীতে চরম ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত একটি পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানানোয় এই সিদ্ধান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও এর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গাজার বেসামরিক নাগরিকদের স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে এই ধরনের গণ-স্থানান্তর আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল হতে পারে। যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, এই স্থানান্তর হবে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলক এবং আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড মেনেই তা করা হবে।

তবে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থাগুলোর মতে, ইসরায়েলের যুদ্ধ গাজায় জীবনযাত্রাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় জরুরি ত্রাণ কর্মকর্তা মার্টিন গ্রিফিথস গাজা উপত্যকাকে ‘বসবাসের অযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, সেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত তাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের অনুমোদনের ফলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রশাসন তৈরি করা হবে, যা ‘গাজার যে বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় অন্য দেশে যেতে চান, তাদের নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিতভাবে সরিয়ে নেওয়ার’ ব্যবস্থা করবে। এই প্রশাসনের কাজ হবে ‘গাজা উপত্যকার প্রবেশপথগুলোতে উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং চলাচলের পথ তৈরি করা’।

ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, এই পরিকল্পনা ট্রাম্পের সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যেখানে তিনি গাজাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে, ফিলিস্তিনিদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাঠিয়ে দিয়ে অঞ্চলটিকে একটি ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’য় পরিণত করতে চেয়েছিলেন।

ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ভার্সেন আঘাবেকিয়ান শাহীন গত মাসে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমিতেই দৃঢ়ভাবে থাকতে চায় এবং তারা স্থানান্তরিত হবে না।

অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইসরায়েল যে সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে, তা কাৎজের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে।

যদিও ট্রাম্প সম্প্রতি এক বক্তব্যে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের বিষয়ে তার আগের মন্তব্যের কিছুটা সুর নরম করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কাউকে বিতাড়িত করা হচ্ছে না’।

গত বছর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও বলেছিলেন, তার দেশ ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার বা গাজা দখলের কোনো পরিকল্পনা করে না।

তবে ট্রাম্পের প্রস্তাব এই ধারণাটিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরা গাজার গণ-স্থানান্তরকে যুদ্ধের একটি সমাধান হিসেবে প্রকাশ্যে আলোচনা করছেন।

এদিকে, ইসরায়েলের মানবাধিকার সংগঠন ‘পিস নাও’ এই পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলেছে, ‘গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের জন্য প্রশাসন তৈরি করা একটি দিশাহীন সরকারের সবচেয়ে বোকাসুলভ পদক্ষেপ’।

এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আরব দেশগুলো, বিশেষ করে মিশর ও জর্ডান। কারণ, ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের ফলে তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের ফলে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

স্মোট্রিচ আরও জানান, নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণেরও অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে পশ্চিম তীরের ১৩টি এলাকাকে বিদ্যমান বসতি থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র বসতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার মধ্যে যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখার জন্য মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে ইসরায়েল আরব মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের দিকে ঝুঁকছে।

স্মোট্রিচ আরও বলেন, ‘আমরা নিজেদের লুকানোর পরিবর্তে পতাকা উত্তোলন করছি, নির্মাণ করছি এবং বসতি স্থাপন করছি। এটা জুদিয়া ও সামারিয়ায় (ইসরায়েলের ভাষায় পশ্চিম তীর) সার্বভৌমত্বের পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’।

ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের একটি সংগঠন ‘ইয়েশা কাউন্সিল’ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ১৫০টি বসতি ছিল। তারা বলেছে, এই সিদ্ধান্ত ‘দীর্ঘদিনের মিথ্যা’ উন্মোচন করে যে ইসরায়েল নতুন কোনো বসতি স্থাপন করে না, বরং বিদ্যমান বসতির ‘আশেপাশে এলাকা তৈরি করে’। তাদের মতে, এটি শান্তি ও নিরাপত্তার ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করার আরেকটি পদক্ষেপ।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *