গাজায় ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশের অনুমতি ইসরায়েলের, মানবিক সংকটে উদ্বিগ্ন বিশ্ব
গাজা উপত্যকায় গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে অবরোধের পর অবশেষে খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ করতে শুরু করেছে ইসরায়েল। তবে আন্তর্জাতিক মহল বলছে, এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
সোমবার থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫টি ট্রাকে ত্রাণ পাঠানো হয়েছে, যেখানে যুদ্ধ বিরতির সময় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক পর্যন্ত প্রবেশ করত।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, মিত্র দেশগুলোর চাপের কারণেই তিনি এই অবরোধ শিথিল করতে বাধ্য হয়েছেন। সম্প্রতি ইসরায়েলি হামলায় গাজায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং সেখানকার মানবিক সংকট গত ১৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও ত্রাণ বিতরণকারী সংগঠনগুলো এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও তারা বলছে, যে পরিমাণ ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে, তা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। খাদ্য সংকটের চরম পরিস্থিতিতে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়া, আরও ১০ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার মতো ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলো গাজায় ইসরায়েলের পদক্ষেপকে ‘অথেষ্ট’ হিসেবে বর্ণনা করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
ইসরায়েল কেন মানবিক সহায়তা বন্ধ রেখেছিল?
গত ২রা মার্চ, ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করে। তাদের যুক্তি ছিল, হামাসকে আলোচনার টেবিলে আনতে এবং তাদের সঙ্গে হওয়া আগের একটি চুক্তিতে পরিবর্তন আনতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
যদিও এর কয়েক সপ্তাহ পরেই ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলা চালায়, যাতে বহু ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়।
ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে ত্রাণ সহায়তা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এনেছে, যদিও তারা এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সহায়তা বিতরণের ক্ষেত্রে এমন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা ত্রাণ বিতরণে কোনো ধরনের কারচুপি হওয়া থেকে রক্ষা করবে।
অন্যদিকে, গত বছরের ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত হয়েছিল প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি। সেই হামলায় প্রায় ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
ইসরায়েলের দাবি, জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যেও এই অবরোধ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় এ পর্যন্ত ৫৩,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
হামাস জানিয়েছে, তারা অবশিষ্ট ৫৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি, যদি তাদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হয়। তবে নেতানিয়াহু এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গাজার উপর অবরোধের প্রভাব
ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজার খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
স্থানীয় বাজারে সামান্য কিছু সবজি পাওয়া গেলেও সেগুলোর দাম আকাশছোঁয়া। অনেক মানুষ এখনো পর্যন্ত ত্রাণ শিবিরের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু খাদ্য সংকটের কারণে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ খাবার সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু তাদের অনেকেই খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, এ বছর এখন পর্যন্ত ৯,০০০ এর বেশি শিশুকে অপুষ্টির চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, অপুষ্টির শিকার হওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারী, অসুস্থ, বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বলছে, গাজার প্রায় ২০ শতাংশ গর্ভবতী নারী অপুষ্টির শিকার এবং তাদের অর্ধেকের বেশি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার মধ্যে রয়েছেন।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ হয় অপরিণত অবস্থায় জন্ম নিয়েছে, না হয় অপুষ্টি বা অন্যান্য জটিলতায় ভুগছে।
হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা সামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় আহতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনা
নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের হাত থেকে ত্রাণ সরিয়ে নেওয়ার জন্য তারা একটি নতুন পদ্ধতি চালু করতে চান। এর অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ‘গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংস্থা সেখানে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নেবে।
এই ফাউন্ডেশনে মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদার, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। তারা চারটি কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করার পরিকল্পনা করছেন, যেখানে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছানো যাবে।
তবে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো এই পরিকল্পনার সঙ্গে একমত নয়। তাদের মতে, এই পদ্ধতিতে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না এবং এতে ইসরায়েলের ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, যা মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী।
এছাড়া, এটি গাজার দক্ষিণাঞ্চলে নতুন করে বাস্তুচ্যুতির কারণ হবে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বলছে, গাজার বাইরে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে এবং ইসরায়েল অনুমতি দিলে তারা দ্রুততার সঙ্গে তা বিতরণ করতে পারবে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস