গাজায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে, ৫০ শতাংশের বেশি এলাকা তাদের দখলে।
তেল আবিব, ইসরায়েল : গত এক মাসে গাজা উপত্যকায় নিজেদের সামরিক অভিযান আরও জোরদার করেছে ইসরায়েল। বর্তমানে ফিলিস্তিনের এই ভূখণ্ডের অর্ধেকের বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে।
ফিলিস্তিনিদের জন্য জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
ইসরায়েলি সৈন্য ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গাজা সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি সবচেয়ে বড় এলাকাটি এখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এখানে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি, কৃষি জমি ও অবকাঠামো ধ্বংস করে এলাকাটিকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হয়েছে।
সামরিক এই বাফার জোনের আকারও সম্প্রতি দ্বিগুণ করা হয়েছে।
ইসরায়েল বলছে, ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হামলায় জিম্মি হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে এবং তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই তারা এমনটা করছে।
তবে মানবাধিকার সংস্থা ও গাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের হাতে থাকা এই ভূমি, যার মধ্যে গাজার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সংযোগকারী একটি করিডোরও রয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজে লাগতে পারে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, হামাসকে পরাজিত করার পরও গাজায় নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হবে।
যুদ্ধ শুরুর ১৮ মাস পর থেকে ইসরায়েলি সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে এবং বাফার জোনের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে।
পাঁচজন ইসরায়েলি সৈন্যের বরাত দিয়ে এমনটাই জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সৈন্যদের একজন বলেন, “তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।
তাদের ফেরার আর কোনো পথ নেই। তারা আর কোনোদিন ফিরতে পারবে না।
ধ্বংসযজ্ঞের দায়িত্বে থাকা সেনাদের তত্ত্বাবধানে থাকা একটি ট্যাংক বহরের সদস্য ছিলেন তিনি।
সোমবার ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামের একটি সংগঠন, যারা ইসরায়েলি সেনাদের কার্যক্রমের সমালোচনা করে, বাফার জোনে মোতায়েন সৈন্যদের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ওই প্রতিবেদনে কয়েকজন সৈন্যের জবানবন্দি রয়েছে, যেখানে তারা দেখেছেন কীভাবে সেনাবাহিনী ওই এলাকাটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
সংগঠনটি জানায়, “ব্যাপক ও পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ভবিষ্যতে ওই এলাকার ওপর ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।
সৈনিকদের এই অভিযোগের বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কাজ করছে।
বিশেষ করে, ৭ অক্টোবরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদার করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
সেনাবাহিনী আরও জানায়, গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই এবং তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনেই কাজ করে।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স জানিয়েছে, যুদ্ধের শুরুতে ইসরায়েলি সেনারা সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি থাকা ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করে এবং এক কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত এলাকা জুড়ে ভূমি ধ্বংস করে বাফার জোন তৈরি করে।
এছাড়াও, তারা গাজার অভ্যন্তরে ‘নেতজারিম করিডোর’ নামে পরিচিত একটি ভূমি দখল করে, যা গাজার উত্তরাঞ্চলকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
এই অঞ্চলে ২০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস।
গত মাসে ইসরায়েল যখন আবার যুদ্ধ শুরু করে, তখন তারা বাফার জোনের আকার দ্বিগুণ করে এবং কিছু কিছু জায়গায় তা গাজার ভেতরে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত করে।
বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ইয়াকোভ গার্ব, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ভূমি ব্যবহারের ধরন নিয়ে গবেষণা করছেন, তার মতে বাফার জোন ও নেতজারিম করিডোর মিলে গাজার প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা গঠিত।
গত সপ্তাহে নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, ইসরায়েল গাজার দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি করিডোর তৈরি করতে চায়, যা রাফা শহরকে গাজার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।
ইসরায়েল সম্প্রতি যেসব এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে যেতে বলেছে, তাদের হিসাব ধরলে গাজার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও অনেক বেশি।
বর্তমানে ইসরায়েলের বাফার জোন হিসেবে পরিচিত এলাকায় একসময় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বসবাস করতেন।
একসময় এটি ছিল গাজার কৃষি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র।
স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা যায়, এককালের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে সেখানে এক ডজনেরও বেশি ইসরায়েলি সেনা ছাউনি তৈরি হয়েছে।
জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর, নিদাল আলজানিন নামের এক ব্যক্তি গাজার উত্তরাঞ্চলের বাইত হানুন-এ নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন।
তার বাড়িটি বাফার জোনের কাছাকাছি ছিল এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
এখন তার কাছে যা অবশিষ্ট আছে তা হলো, তার ও স্ত্রীর বিয়ের একটি ছবি, একটি চীনামাটির প্লেটে ছেলের আঁকা ছবি এবং তার দাদার রোপণ করা ১৫০ বছরের পুরনো একটি সিকামোর গাছের কঙ্কাল।
তার গ্রিনহাউসটি পরিণত হয়েছিল ভাঙা লোহার স্তূপে।
৫৫ বছর বয়সী এই কৃষক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি তাঁবু স্থাপন করেন, জীবন পুনর্গঠনের আশায়।
কিন্তু ইসরায়েল যখন আবার অভিযান শুরু করে এবং তার জমি দখল করে নেয়, তখন তাকে আবারও উচ্ছেদ করা হয়।
গাজা শহরে আশ্রয় নেওয়া নিদাল আলজানিন বলেন, “একটি বাড়ি তৈরি করতে আমার ২০ বছর লেগেছিল, আর তারা পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার ও আমার সন্তানদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের বোমা হামলা ও স্থল অভিযানের কারণে গাজার শহর ও জনপদগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।
তবে সৈন্যদের ভাষ্যমতে, বাফার জোনের ভেতরের সম্পত্তি ধ্বংসের কাজটি ছিল আরও সুপরিকল্পিত ও ব্যাপক।
এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাঁচজন সৈন্য জানান, ইসরায়েলি সেনারা কৃষি জমি, সেচের পাইপ, শস্য ও গাছপালা ধ্বংস করার নির্দেশ পেয়েছিল।
এছাড়াও, হাজার হাজার ভবন, যার মধ্যে আবাসিক ও সরকারি কাঠামোও ছিল, সেগুলোও ধ্বংস করা হয়, যাতে জঙ্গিরা লুকানোর জায়গা না পায়।
কয়েকজন সৈন্য বলেছেন, তাদের ইউনিটগুলো এত বেশি ভবন ধ্বংস করেছে যে, তারা সংখ্যা গুনতে পারেনি।
এর মধ্যে বড় বড় শিল্প কমপ্লেক্সও ছিল।
একটি সোডা ফ্যাক্টরি ভেঙে ফেলা হয়, যেখানে কাঁচ ও সৌর প্যানেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
সৈনিকের অভিযোগ, বাফার জোন একটি ‘হত্যা অঞ্চল’।
সৈন্যরা জানিয়েছেন, বাফার জোনের কোনো চিহ্নিত সীমানা ছিল না, তবে সেখানে প্রবেশ করা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানো হতো।
ট্যাংক বহরের ওই সৈন্য জানান, একটি সাঁজোয়া বুলডোজার ভূমি সমতল করে ‘হত্যা অঞ্চল’ তৈরি করেছে এবং ট্যাংকের ৫০০ মিটারের মধ্যে কেউ এলে, নারী ও শিশুসহ তাদের গুলি করা হবে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ৭ অক্টোবরের হামলার প্রতিশোধ নিতে অনেক সৈন্য এমনটা করেছে।
তিনি বলেন, “আমি সেখানে গিয়েছিলাম কারণ তারা আমাদের মেরেছিল, আর এখন আমরা তাদের মারব।
কিন্তু আমি দেখলাম, আমরা শুধু তাদের মারছি না, আমরা তাদের স্ত্রী, সন্তান, বিড়াল, কুকুরসহ তাদের ঘরবাড়িও ধ্বংস করছি।
সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের হামলা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এবং তারা ‘অ-যুদ্ধকারীদের’ ক্ষতির বিষয়টি যথাসম্ভব এড়িয়ে যায়।
ইসরায়েল কত দিন গাজার ভেতরে বাফার জোন ও অন্যান্য এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দক্ষিণ গাজায় নতুন করিডোর তৈরির ঘোষণা দিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করে জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা, যাদের মধ্যে ধারণা করা হয়, ৫৯ জন এখনো বন্দী এবং ৩৫ জন মারা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, হামাসকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত এবং তাদের নেতারা গাজা ত্যাগ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে না।
এরপর ইসরায়েল ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ নেবে।
নেতানিয়াহু আরও বলেন, এরপর ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহ্বান বাস্তবায়ন করবে, যা ইসরায়েল ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসন’ বলে অভিহিত করে।
কিছু ইসরায়েলি বিশ্লেষক মনে করেন, বাফার জোনের উদ্দেশ্য গাজা দখল করা নয়, বরং হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ইসরায়েলের দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন ঊর্ধ্বতন গবেষক কোবি মাইকেল বলেন, “শত্রু পক্ষের সঙ্গে সীমান্ত থাকা যেকোনো দেশের জন্য এটি একটি স্বাভাবিক কাজ।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, জোরপূর্বক মানুষকে স্থানান্তরিত করা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক নাদিয়া হার্ডম্যান বলেন, গাজার বাফার জোনে, এটি জাতিগত নির্মূলের শামিল, কারণ এখানে মানুষজনকে আর ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হবে না।
ইসরায়েল এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে এবং বলেছে, বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার জন্য তারা তাদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।