গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনা, যা জাতিগত নিধনের শামিল হতে পারে।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল সরকার সেখানকার ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য নতুন একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে গাজাকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে সেখানকার অধিবাসীদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশ্লেষকরা এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তাদের মতে, এই পদক্ষেপ কার্যত জাতিগত নিধনের শামিল হতে পারে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর দাবি, এর মূল উদ্দেশ্য হলো হামাসকে নির্মূল করা এবং গত ৭ অক্টোবর হামাস কর্তৃক ইসরায়েলে বন্দী হওয়া জীবিতদের উদ্ধার করা।
নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেন, গাজায় ‘শক্তিশালী অভিযান’ চালানো প্রয়োজন এবং সেখানকার অধিবাসীদের সুরক্ষার জন্য তাদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইসরায়েল গাজার উত্তরাঞ্চলের কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে ৬টি নির্দিষ্ট স্থানে সরিয়ে নেবে। সেখানে তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা হবে এবং ত্রাণ সংস্থা ও বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তা বিতরণ করা হবে।
ফিলিস্তিনিদের হয় ওই স্থানগুলোতে যেতে হবে, নয়তো অনাহারে দিন কাটাতে হবে। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি শিবিরে ৫ থেকে ৬ হাজার পরিবারকে রাখা হবে।
পরিবারগুলোর সদস্যরা কয়েক মাইল পথ হেঁটে গিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করতে বাধ্য হবে। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের কর্মকর্তা ইয়ান ইগেল্যান্ডের মতে, এই স্থানগুলো “কনসেনট্রেশন হাব”-এর মতো।
গাজার অবশিষ্ট জনসংখ্যার – যাদের সংখ্যা ১৫ লক্ষের মতো হতে পারে – খাদ্যের সংস্থান কিভাবে হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল জানিয়েছে, খাদ্য বিতরণের সময় তারা মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, যাতে ‘হামাস’-এর সঙ্গে জড়িত কাউকে ত্রাণ দেওয়া না হয়।
তবে, ইসরায়েল প্রায় সকল বয়স্ক পুরুষকেই হামাস যোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ওই এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে থাকবে।
বিশেষজ্ঞ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এই পরিকল্পনাকে অমানবিক ও বাস্তবায়ন অযোগ্য বলে অভিহিত করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইসরায়েলের এই পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই পদক্ষেপের কারণে আরও বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হবে এবং গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ আরও বাড়বে।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গাজার ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ইসরায়েলের এই পরিকল্পনা মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী।
ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) সাবেক উপদেষ্টা ও আইন বিশেষজ্ঞ ডায়ানা বুত্তু আল জাজিরাকে বলেন, “যদি এই পরিকল্পনাকে ত্রাণ বিতরণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তাহলে এর কোনো অর্থ হয় না।
তবে, যদি এটিকে জাতিগত নিধন এবং খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে গাজাকে খণ্ড-বিখণ্ড করার রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে দেখা হয়, তাহলে এই পরিকল্পনার একটা অর্থ আছে।”
গাজায় বসবাসকারী ৩১ বছর বয়সী নূর আয়াশ প্রশ্ন করেন, “যদি তারা যুদ্ধ বাড়াতে চায় এবং গাজাকে পুনরায় দখল করতে চায়, তাহলে কেন আমাদের উত্তরে ফিরতে দেওয়া হলো? নেতানিয়াহু আর কী চান? আমরা তো সব দিক থেকে মরছি।”
এদিকে, ৭৬ বছর বয়সী মাহমুদ আল-নাবাহিন গত ১৮ মাস ধরে বাস্তুচ্যুত হয়ে আছেন। তিনি বলেন, নেতানিয়াহুর হুমকি অর্থহীন।
তিনি ইতোমধ্যে তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে হারিয়েছেন, তাঁদের বাড়ি ও খামারও ধ্বংস হয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ওমর রহমান বলেছেন, “খাদ্য সহায়তা দেওয়ার এবং ইসরায়েলি বন্দীদের উদ্ধারের আড়ালে ইসরায়েল আসলে তাদের গণহত্যা সম্পন্ন করতে চাইছে।”
কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিশেষজ্ঞ হাইডি ম্যাথিউস বলেছেন, ইসরায়েলের এই পরিকল্পনা গাজার ফিলিস্তিনিদের অনাহার ও গণহত্যার দিকে ঠেলে দেবে।
এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ডায়ানা বুত্তুর মতে, জাতিসংঘের উচিত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা, কারণ তারাই মূলত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকে অর্থ সরবরাহ করে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা