গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহ অভিযান: ফিলিস্তিনিদের জীবনে নেমে এলো ভয়ঙ্কর বিপদ!

গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান আরও জোরদার, বিস্তীর্ণ এলাকা দখলের ঘোষণা।

গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভিযান ক্রমাগত বাড়ছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বিরাট অংশ নিজেদের ‘নিরাপত্তা অঞ্চলের’ অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে তেল আবিব।

বুধবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। একই সঙ্গে গাজায় অবিরাম বোমা হামলা চলছে, যাতে এরই মধ্যে অন্তত ২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার মুখে এরই মধ্যে রাফা শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কতখানি এলাকা দখল করতে চায়, তা স্পষ্ট করেননি। তবে তিনি বলেছেন, হামাস জঙ্গিদের নির্মূল করতে এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করতে এই অভিযান চালানো হচ্ছে।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাঁর আহ্বান, হামাসকে সরিয়ে জিম্মিদের মুক্তি দিতে সাহায্য করুন, যাতে যুদ্ধ শেষ করা যায়।

ইতিমধ্যেই, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজার ভেতরে একটি বিশাল বাফার জোন তৈরি করেছে। যা যুদ্ধের আগে গাজার প্রান্তের কিছু অংশে ছিল, তা আরও বাড়ানো হয়েছে।

এমনকি নেজারিম করিডোর-সহ গাজার মধ্যাঞ্চলে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির পুনর্গঠনের জন্য হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এক মাস আগে গাজায় সব ধরনের পণ্য প্রবেশ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চান, হামাস যেন গাজায় আটকে থাকা ৫৯ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়। এর বিনিময়ে তিনি ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি এবং গাজার জন্য মানবিক সহায়তা দিতে রাজি।

তবে যুদ্ধ বন্ধ এবং গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে তিনি নারাজ।

অন্যদিকে, হামাস আগের চুক্তিতে ফিরে আসার কথা বলছে। তারা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে একসঙ্গে সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত।

এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় বোমা হামলা জোরদার করেছে। গত ১৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

সোমবার, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত রাফার বাসিন্দাদের এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয়। মঙ্গলবার, তারা এই নির্দেশ গাজার উত্তরে অবস্থিত বেইত হানুন, বেইত লাহিয়া এবং আশেপাশের এলাকাগুলোতেও জারি করে।

জানা গেছে, এই অভিযানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ৩৬তম ডিভিশনকে গাজায় মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার ভোরে সেনারা গাজায় প্রবেশ করে।

রাফার খিরবেত আল-আদাস এলাকার ফিলিস্তিনের অনেক পরিবার জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় তারা আটকা পড়েছে। তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য চেয়েছেন তাঁরা।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, বুধবারের হামলায় নিহত ২১ জনের মধ্যে খান ইউনিসে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন ১২ জন। রাফায় নিহত হয়েছেন আরও দুইজন।

এছাড়া, আল-মাওয়াসির তথাকথিত নিরাপদ অঞ্চলে একজন এবং নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে আরও দুজন নিহত হয়েছেন।

গাজার মধ্যাঞ্চলে দেইর আল-বালাহ থেকে আল-জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজম জানিয়েছেন, রাফার বাসিন্দারা নিজেদের সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। এক বছর আগে, মিশর সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত রাফা শহরে ১৪ লাখ মানুষের বসবাস ছিল।

তাঁদের মধ্যে ১০ লাখের বেশি মানুষ গাজার অন্যত্র ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু মে মাসে ইসরায়েল শহরটি দখল করে নিলে সেখানকার প্রায় সবাই পালাতে বাধ্য হয়।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই মাস পর্যন্ত সেখানে মাত্র ৫০ হাজার মানুষ ছিলেন।

জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলি বাহিনী আংশিকভাবে সরে গেলে বাসিন্দারা ফিরতে শুরু করেন। আবু আজম বলেন, “এখন মানুষ আবার পালাচ্ছে। তারা জানে, গাজায় কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই।”

জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, “রাফা থেকে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ গুলির মধ্যে পালাচ্ছে।”

সংস্থাটিকে দেওয়া এক বৃদ্ধ জানান, ইসরায়েলি বাহিনী তাঁদের এবং অন্যান্য বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালিয়েছে। তিনি বলেন, “অনেকে আহত হয়ে চিৎকার করছিল, কিন্তু আমি ভয়ে পিছনে তাকাতে পারিনি।”

আরেকজন নারী বলেন, “আমরা পালিয়ে বালির টিলা দিয়ে হেঁটে গিয়েছি। আমি যখন পালিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন [ইসরায়েলি] ট্যাংকগুলো রাস্তার পাশে তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেয়।”

এদিকে, ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, “ভূখণ্ড দখলের জন্য কি জিম্মিদের বলি দেওয়া হচ্ছে?”

তাঁরা আরও বলেন, “চুক্তি করে জিম্মিদের মুক্ত করার পরিবর্তে, ইসরায়েলি সরকার আরও সেনা পাঠাচ্ছে, যেখানে আগে থেকেই বারবার যুদ্ধ হয়েছে।”

গাজায় খাদ্য সংকট আরও তীব্র হয়েছে, কারণ ইসরায়েলি অবরোধের কারণে সেখানকার বেকারিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) পরিচালিত ২৫টি বেকারিও এর অন্তর্ভুক্ত।

ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, অবরোধের কারণে গাজা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।

জাতিসংঘ অবরোধ তুলে নেওয়ার এবং যুদ্ধবিরতি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফানে দুজারিক ইসরায়েলের এই দাবিকে ‘হাস্যকর’ বলেছেন যে গাজায় পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ রয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা মানবিক করিডোর দিয়ে আসা সরবরাহের শেষ প্রান্তে আছি… ডব্লিউএফপি এমনি এমনি তাদের বেকারি বন্ধ করে না। যুদ্ধবিরতির সময় আমরা দেখেছি, গাজায় মানবিক সহায়তা এসেছে, বাজারগুলো আবার চালু হয়েছে, দাম কমেছে, জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

আমাদের সেই পরিস্থিতিতে ফিরতে হবে।”

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *