গাজায় বড় ধরনের স্থল অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল
গাজায় বড় ধরনের স্থল অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। এর অংশ হিসেবে সম্ভবত কয়েক হাজার সেনা সেখানে পাঠানো হবে। ইসরায়েলের একজন কর্মকর্তা এবং এই বিষয়ে অবগত অন্য একটি সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, হামাসকে চাপ প্রয়োগ করতে এবং জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
এই সম্ভাব্য অভিযানটি ইসরায়েলি সরকারের বিবেচনাধীন কয়েকটি পরিস্থিতির মধ্যে অন্যতম। গাজায় হামলা জোরদার করা এবং হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ না করেই জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে চাইছে তারা।
সম্প্রতি কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, বড় ধরনের স্থল অভিযানের খবর প্রচার করা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামাসের উপর আলোচনার টেবিলে চাপ বাড়ানোর কৌশল। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আগে জানিয়েছিলেন, হামাস যদি জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি হয়, তাহলে তারা হামলা বন্ধ করতে প্রস্তুত।
নতুন ও আগ্রাসী সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আইয়াল জামিরের নেতৃত্বে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজায় বড় ধরনের অভিযানের পরিকল্পনা করছে।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক প্রধান আইয়াল হুলাতা সিএনএনকে বলেন, “যদি জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু না হয়, তাহলে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না। আর সে জন্য গুরুতর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।”
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় এর আগেও বেশ কয়েকটি স্থল অভিযান চালিয়েছে। তবে, হামাস যোদ্ধাদের বিতাড়িত করার কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যেই তারা এলাকাটি ছেড়ে আসে। এরপর হামাস পুনরায় সেখানে ফিরে আসে। বর্তমানে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার বিশাল এলাকা থেকে হামাসকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, যাতে হামাস পুনরায় ফিরে আসতে না পারে। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বছরের পর বছর ধরে সেখানে অবস্থান করতে পারে।
সূত্রগুলো বলছে, এই বিশাল স্থল অভিযানে সম্ভবত পাঁচটি ইসরায়েলি ডিভিশন—অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার সেনা অংশ নিতে পারে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর চিফ অব অপারেশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ইসরায়েল জিভ সিএনএনকে বলেন, “সরকার হামাসকে ইসরায়েলের শর্তে আলোচনায় বসতে রাজি করাতে চাইছে। তবে সমস্যা হলো, একবার উত্তেজনা বাড়লে শেষ পর্যন্ত গভীর সংকটে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ঝুঁকি রয়েছে, যা কাজ করবে কিনা, তা কেউ জানে না।”
তিনি আরও বলেন, “কোনো হুমকি দিলে, তা কার্যকর করার প্রস্তুতিও থাকতে হয়।”
ইতিমধ্যে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বৃহত্তর স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তারা গাজার উত্তরাঞ্চলকে বাকি অংশ থেকে আলাদা করা নেটজারি করিডোরের অর্ধেক পুনরুদ্ধার করেছে এবং গাজার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে কৌশলগত অবস্থানে সেনা পাঠিয়েছে।
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে “স্বেচ্ছায় স্থানান্তরের” সুবিধার্থে গত রোববার ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা একটি সংস্থা গঠনের অনুমোদন দিয়েছে। যদিও কোনো দেশ এখনো তাদের গ্রহণ করতে রাজি হয়নি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় হামাসের সামরিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা নির্মূল করাকে যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি “পরিপূর্ণ বিজয়” অর্জনের অঙ্গীকার করেছেন।
তবে, গাজায় বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদি ইসরায়েলি সামরিক অভিযান সম্ভবত ইসরায়েলি জনগণের কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে পারে। কারণ, দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনো হামাসের হাতে বন্দী ৫৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করার জন্য আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে।
হুলাতা বলেন, “আমরা দেখব, সেখানে আইডিএফের (ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স) স্থায়ী উপস্থিতি থাকবে এবং তারা বিদ্রোহ দমনের জন্য যুদ্ধ করবে। এছাড়া, মানবিক সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব আইডিএফকে নিতে হবে।”
মার্চের শুরু থেকে ইসরায়েল গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে, যা সেখানকার মানবিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জিভ বলেন, গাজার আরও বেশি অঞ্চল দখল করা “অন্তত এই মুহূর্তে ইসরায়েলের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়”। তিনি আরও বলেন, “সরকারের চরমপন্থীদের কেউ কেউ, যেমন—অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ হয়তো এমনটাই চান। তবে, এই মুহূর্তে এটাই ইসরায়েলের সেরা নীতি নয়।”
৯ মার্চ ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করে জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর পক্ষে ছিল।
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া জিম্মিরা এবং এখনো বন্দী থাকা জিম্মিদের পরিবার সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু হলে এখনো জীবিত থাকা ২৪ জন জিম্মির জীবন আরও ঝুঁকিতে পড়বে।
তবে, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক অগ্রাধিকার সম্ভবত ভিন্ন। তার ডানপন্থী জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা জিম্মি মুক্তির জন্য আলোচনার পরিবর্তে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরুর পক্ষে।
নেতানিয়াহুর উপদেষ্টারা মনে করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের বৃহত্তর সামরিক পদক্ষেপের প্রতি বেশি সমর্থন জানাবেন। বাইডেন গাজার জনবহুল দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের বড় ধরনের অভিযান প্রতিরোধের জন্য কিছু অস্ত্রের চালান স্থগিত করেছিলেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গত সপ্তাহে সামরিক বাহিনীর স্থল অভিযান বড় পরিসরে বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, তিনি আইডিএফকে অতিরিক্ত এলাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছেন, একইসঙ্গে সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে বলেছেন।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “হামাস তাদের অস্বীকৃতি অব্যাহত রাখলে, ইসরায়েল তাদের আরও বেশি অঞ্চল কেড়ে নেবে।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন