তেহরানে মৃত্যুভয়: ইসরায়েলের বোমা হামলায় বাড়ছে উদ্বেগ, বাড়ছে আশ্রয় খোঁজার হাহাকার

ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলের লাগাতার বোমা হামলায় শহরজুড়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে বহু মানুষ মেট্রো স্টেশনের মেঝেতে রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। খবর সূত্রে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের এক কোটি বাসিন্দাকে শহর ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

বোমা হামলার কারণে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অনেকে শহরতলীর দিকে, কেউ কাস্পিয়ান সাগরের দিকে, আবার কেউ বা প্রতিবেশী দেশ আর্মেনিয়া কিংবা তুরস্কের দিকে ছুটছে। কিন্তু বৃদ্ধ ও অসুস্থ স্বজনদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকে, যারা উঁচু ভবনে আটকা পড়েছেন।

আত্মীয়-স্বজনেরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

একটি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৮৫ জন নিহত এবং ১,৩০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। সেখানকার স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোও হামলার শিকার হওয়ায় খবর প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে ইরানের সাধারণ মানুষ বাইরের জগৎ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

সরকারি কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না। পুলিশের উপস্থিতি খুবই কম, বিমান হামলার সাইরেনগুলোও নির্ভরযোগ্য নয় এবং হামলার সময় কী করতে হবে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

তেহরানের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী ৪৯ বছর বয়সী শিরিন নামের একজন নারী জানান, গত কয়েক দিনে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে তার প্রতিটি ফোন বা টেক্সট বার্তা যেন শেষ বার্তা মনে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না, আগামীকাল আমরা বেঁচে থাকব কিনা।’

অনেক ইরানি এই পরিস্থিতিতে দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর ইসরায়েলের হামলার সমর্থন করছেন, কারণ তাদের মতে, তারা নিপীড়নকারী। আবার অনেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে এবং ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে।

এছাড়া, এমনও অনেকে আছেন যারা ইরানের শাসকদের বিরোধিতা করেন, কিন্তু তাদের দেশটিতে বোমা হামলা হোক, তা চান না।

এই পরিস্থিতিতে, শহর ছেড়ে যাবেন নাকি থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়েছেন অনেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ইরানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন ইরানি-আমেরিকানকে টেলিফোনে সাক্ষাৎকার নিয়েছে এসোসিয়েটেড প্রেস। তারা সবাই হয় নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছেন, নয়তো শুধুমাত্র তাদের প্রথম নাম ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন, কারণ তারা আশঙ্কা করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বা তাদের পরিবারের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হতে পারে।

বেশিরভাগ কল অল্প সময়ের মধ্যেই কেটে যায়, কারণ মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিল অথবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ইরানের সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা স্বীকার করেছে। তাদের দাবি, দেশের সুরক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যদিও এর ফলে সাধারণ ইরানিরা বাইরের জগৎ থেকে তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রবাসে বসবাস করা ইরানিরা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে খবর জানার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন ইরানি-আমেরিকান মানবাধিকার গবেষক জানান, তিনি সর্বশেষ তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন, যখন তারা তেহরান ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি মনে করেন, গ্যাস সংকট এবং যানজটের কারণে তারা শহর ছাড়তে পারেননি।

তিনি আরও জানান, তার পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা, যাদের সঙ্গে তিনি ইরানে বড় হয়েছেন, তাদের উদ্বেগজনক বার্তা ছিল, ‘কোথায় যাব, জানি না। যদি মরে যাই, তবে মরেই যাব।’

কিছু পরিবার ইতোমধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ইরানে চার বছর ধরে বসবাস করা ২৩ বছর বয়সী একজন আফগান শরণার্থী জানিয়েছেন, তিনি তেহরানেই ছিলেন, কিন্তু সোমবার একটি ফার্মেসিতে বোমা হামলার পর তিনি তার স্ত্রী ও নবজাত ছেলেকে শহর থেকে বের করে দিয়েছেন।

আর্শিয়া নামের ২২ বছর বয়সী একজন জানান, তিনি এখন ক্লান্ত। তিনি বলেন, ‘আমি ৪০ ঘণ্টা, ৩০ ঘণ্টা, ২০ ঘণ্টা ট্র্যাফিকের মধ্যে যেতে চাই না, শুধু এমন একটা জায়গায় যাওয়ার জন্য, যেখানে হয়তো বোমা পড়বে।’

ইসরায়েলি হামলার পর থেকে তিনি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়িতেই থাকছেন। তিনি জানান, তেহরানের সা’আদাতাবাদ এলাকা, যা একসময় বেশ প্রাণবন্ত ছিল, এখন ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। স্কুল বন্ধ রয়েছে।

খুব কম লোকই এখন তাদের কুকুরদের নিয়ে হাঁটতে বের হয়। বেশিরভাগ দোকানে খাবার পানি ও রান্নার তেল ফুরিয়ে গেছে। দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে।

শিরিন জানান, শহর ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তেহরানের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলো উঁচু এবং ঘনবসতিপূর্ণ। তার বাবার আলঝাইমার হয়েছে এবং তাকে সরানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন। মায়ের গুরুতর আর্থ্রাইটিসের কারণে সামান্য পথ পাড়ি দেওয়াও তার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।

অন্যদিকে, যারা শহর ছাড়তে পারছেন না, তারা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার মসজিদ, স্কুল ও মেট্রো স্টেশনগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের কথা বলেছে।

তবে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, আবার কিছুতে অতিরিক্ত ভিড় দেখা যাচ্ছে।

শুক্রবার রাতে তেহরানের একটি মেট্রো স্টেশনে কয়েকশ লোক আশ্রয় নিয়েছিল। ছোট ছোট পরিবারের সদস্যরা মেঝেতে শুয়ে ছিল। অন্য একটি দেশ থেকে আসা একজন শিক্ষার্থী জানান, তিনি তার পরিবারের সঙ্গে ১২ ঘণ্টা স্টেশনে কাটিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে সবাই আতঙ্কিত ছিল। ভবিষ্যতে যুদ্ধ হলে কী হবে, তা তারা জানে না। তাদের মনে হচ্ছে, তাদের জন্য কোনো জায়গা নিরাপদ নয়।’

ওই স্টেশন থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই তিনি দেখেন, ইসরায়েল তেহরানের একটি অংশে সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করেছে।

শিরিনের কাছে এই পরিস্থিতি কিছুটা তিক্ত। তিনি সরকার বিরোধী হলেও ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা এই শাসনের অবসান চাই, তবে কোনো বিদেশি শক্তির হাতে তা হোক, এটা চাই না।

আমরা চাই, যদি কোনো পরিবর্তন আসে, তবে তা ইরানের জনগণের আন্দোলনের ফল হোক।’

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *