ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নতুন মোড় নিয়েছে। উভয় দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ সম্প্রতি নতুন করে সহিংস রূপ নিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
এই দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক, যা কয়েক দশক ধরে নানা বাঁক পেরিয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো:
১৯৬০-এর দশকে, ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। সেই সময়ে, আমেরিকার ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির অধীনে, ইরান তেহরান গবেষণা চুল্লি (Tehran Research Reactor) স্থাপন করে।
১৯৭৯ সালে, ইরানে ইসলামিক বিপ্লব হয়, যেখানে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতায় আসেন। এই পরিবর্তনের ফলে, ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং ইসরায়েলকে ইরানের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
২০০০-এর দশকের শুরুতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিশেষ করে ২০০২ সালে ইরানের গোপন নাতানজ (Natanz) পারমাণবিক কেন্দ্র আবিষ্কারের পর এই উদ্বেগ আরও বাড়ে।
এর পরেই, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের আলোচনা শুরু হয়, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে স্থগিত হয়ে যায়। ২০০৬ সালে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুনরায় শুরুর ঘোষণা দেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
২০০৯ সালে, ইরানের বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাহমুদ আহমেদিনেজাদ পুনর্নির্বাচিত হন। এর ফলশ্রুতিতে, ইরানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ হয় এবং কঠোর হাতে তা দমন করা হয়।
একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ইরানের মধ্যে ওমানের মাধ্যমে গোপনে বার্তা আদান-প্রদান শুরু হয়।
২০১০ সালে, ‘স্টাক্সনেট’ (Stuxnet) নামক একটি কম্পিউটার ভাইরাস আবিষ্কার হয়, যা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ সৃষ্টি ছিল। এই ভাইরাস ইরানের সেন্ট্রিফিউজগুলোতে (centrifuges) ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
২০১৫ সালে, বিশ্ব শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে তেহরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করার বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু ২০১৮ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর থেকে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনা আবারও বাড়ে।
২০২০ সালে, ইরানের নাতানজ পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি রহস্যজনক বিস্ফোরণ হয়, যার জন্য ইরান ইসরায়েলকে দায়ী করে। একই বছর, ইরানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেকে হত্যা করা হয়।
২০২১ সালে, নাতানজের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি সাইবার হামলা হয়। ইরান এর জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে, যদিও ইসরায়েল সরাসরি দায় স্বীকার করেনি।
২০২১ সালের এপ্রিলে, ইরান ৬০% ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে, যা অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি একটি পদক্ষেপ ছিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, হামাস (Hamas) গাজা থেকে ইসরায়েলে হামলা চালায়, যা দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধের সূচনা করে। ইরান হামাসকে সমর্থন জুগিয়েছিল।
এরপর থেকে, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে, যা বিভিন্ন সময়ে সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়।
২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল, সিরিয়ার দামেস্কে (Damascus) অবস্থিত ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সদস্যসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। এর জবাবে, ইরান ইসরায়েলে ৩০০-এর বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
এরপর ইসরায়েলও ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।