ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি: ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভিন্ন মূল্যায়ন
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে, আর এর কারণ হলো ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচি। ইসরায়েল সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে কিছু সামরিক অভিযান চালিয়েছে, এবং তাদের দাবি, তেহরান দ্রুত পরমাণু বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল্যায়ন ভিন্ন। তাদের মতে, ইরান এখনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে কয়েক বছর পিছিয়ে আছে। এই দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ‘থেকাতে’ এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের ধারণা, ইরান খুব দ্রুত পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে, যা তাদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের গোয়েন্দা তথ্য ভিন্ন কথা বলছে। তারা মনে করেন, ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার ক্ষমতা এখনো অনেক দূরে, এবং তাদের এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আরও বলছেন, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে হয়তো কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে দেওয়া গেছে। তবে, ইরানের ‘ফোর্ডো’ নামক সুরক্ষিত পরমাণু কেন্দ্রটির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ফোর্ডো এমন একটি স্থান, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে ফোর্ডোর মতো সুরক্ষিত স্থাপনায় আঘাত হানা কঠিন। সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ব্রेट ম্যাকগার্কের মতে, “ইসরায়েল হয়তো ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলোর ওপর নজর রাখতে পারে, কিন্তু সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে হলে হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, অথবা কোনো সমঝোতা দরকার।”
এই পরিস্থিতিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদিও সরাসরি ইসরায়েলের এই অভিযানে জড়িত হতে চান না, তবে তিনি এটাও জানেন যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে হলে তাদের সামরিক সহায়তা প্রয়োজন। বিশেষ করে, মাটির নিচে থাকা স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য উপযুক্ত বোমা এবং বি-২ বোমারু বিমানের মতো সামরিক সরঞ্জামের প্রয়োজন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানো উচিত, আবার কেউ চান কোনো রকম সামরিক সংঘাতে না জড়াতে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।
তিনি সম্প্রতি বলেছেন, “আমরা এতে জড়িত নই। তবে ভবিষ্যতে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে আমরা কোনো পক্ষেই নেই।”
মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিন্নমত দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড, যারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক কার্যক্রমের দায়িত্বে আছে, তারা ইরানের পারমাণবিক হুমকিকে বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
সংঘাতের এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে তাদের সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। এরই মধ্যে ইউএসএস নিমিতজ ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপকে দ্রুত মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম কিছু মার্কিন নৌ জাহাজও খুব শীঘ্রই পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করা হবে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরান বর্তমানে অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পর্যায়ে ইউরেনিয়াম জমা করেছে। এই তথ্য তাদের উদ্বেগের কারণ।
তবে, অস্ত্র তৈরি করতে পারলেও, সেটি ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য ইরানের আরও অনেক সময় লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান সম্ভবত ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে। কারণ, তাদের অবকাঠামোতে ইতোমধ্যে আঘাত হানা হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের ফোর্ডো পরমাণু কেন্দ্রটির ক্ষতি করা এখনো সম্ভব হয়নি। ব্রेट ম্যাকগার্কের মতে, “যদি ফোর্ডো অক্ষত থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে পারে।”
বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলো কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করছে। তবে, ইরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, ইসরায়েলের হামলার মধ্যে তারা কোনো আলোচনায় বসবে না।
ইসরায়েলও তাদের সামরিক অভিযান বন্ধ করার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যের এই পরিস্থিতি সহজে শান্ত হবে বলে মনে হচ্ছে না।
তথ্য সূত্র: সিএনএন