ইসরায়েলের রাজনীতিতে অস্থিরতা: সামরিক বাহিনীতে অতি-অর্থোডক্সদের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে নেতানিয়াহুর ভবিষ্যৎ।
জেরুজালেম, মে ২৯, ২০২৪ – ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শাসনের ভবিষ্যৎ এখন এক জটিল সমীকরণের সম্মুখীন। গাজায় যুদ্ধ, দেশের অর্থনীতির সংকট এবং দুর্নীতির অভিযোগের মতো গুরুতর বিষয়গুলোর চেয়েও বর্তমানে তার শাসনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনীর জন্য অতি-অর্থোডক্স (আলট্রা-অর্থোডক্স) যুবকদের বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি।
বহু বছর ধরে, ইসরায়েলে সামরিক বাহিনীতে যোগদান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত, সকল ইহুদি পুরুষকে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে হয়। তবে, অতি-অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের যুবকদের ধর্মীয় শিক্ষার কারণে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে অব্যাহতি দেওয়া হতো। এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিদ্যমান। নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জোটের অংশীদার অতি-অর্থোডক্স দলগুলো চাইছে, তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যরা যেন সামরিক বাহিনীতে যোগ না দেয়, সেই মর্মে একটি আইন প্রণয়ন করা হোক।
এই ইস্যুতে বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে। বর্তমানে ইসরায়েলিদের মধ্যে সেনাদের উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে অতি-অর্থোডক্সদেরও দেশের সুরক্ষায় এগিয়ে আসা উচিত।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ইসরায়েলের জন্মের সময় দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন অতি-অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতা করেন। সেই সময় কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ধর্মীয় শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থীকে তোরাহ অধ্যয়নে সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে অতি-অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ছাড়টি একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৬৬ হাজার যুবক সেমিনারিগুলোতে (ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) পড়াশোনা করছেন।
গাজায় যুদ্ধের প্রভাব
গাজায় যুদ্ধ পরিস্থিতি এই বিভেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ ২০ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রায় ৮৭০ জন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। রিজার্ভ সেনাদের বারবার তলব করা হচ্ছে, যার ফলে তারা তাদের চাকরি এবং পরিবার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ইসরায়েলিদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘ হচ্ছে এবং এর একটি সমাধান প্রয়োজন।
অন্যদিকে, অতি-অর্থোডক্সরা বলছেন, তারা প্রার্থনা এবং ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের আশঙ্কা, সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হলে তারা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের সংস্পর্শে আসবেন, যা তাদের ধর্মীয় জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেবে।
রাজনৈতিক সমীকরণ
অতি-অর্থোডক্স সম্প্রদায় ইসরায়েলের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। দেশের হাইকোর্ট গত বছর এক রায়ে জানায়, অতি-অর্থোডক্স পুরুষদেরও বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে, এই নির্দেশ কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু নির্বাচনে জিততে সমস্যায় পড়বেন। তাই, ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে অতি-অর্থোডক্স দলগুলোর সমর্থন তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতি-অর্থোডক্স দলগুলোকে সন্তুষ্ট করতে নেতানিয়াহু তাদের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তার দল লিকুডের কিছু সদস্য এই বিষয়ে আরও ন্যায়বিচারের দাবি করছেন, যা জোটের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে, বিরোধী দলগুলোও এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে। তারা অতি-অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের অসন্তোষ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চাইছে।
ভোট এবং ভবিষ্যৎ
বুধবার বা বৃহস্পতিবার আইনপ্রণেতাদের সংসদে এই বিষয়ে একটি প্রাথমিক ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। অতি-অর্থোডক্স দলগুলোর সমর্থনে বিলটি পাস হলে, এটি প্রথম রিডিংয়ের জন্য কমিটিতে যাবে। এরপর দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত ভোটের জন্য আরও কয়েক দিন বা সপ্তাহ লাগতে পারে।
যদি কোনো ভোট ব্যর্থ হয়, তবে ছয় মাসের জন্য বিরোধী দলগুলো সংসদ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারবে না। যদি বিলটি পাস হয়, তবে নতুন নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হবে, যা সম্ভবত তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস