গাজায় সামরিক অভিযান আরও বড় করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল।
জেরুজালেম থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, গাজা সিটিতে সামরিক অভিযান আরও বড় আকারে শুরু করার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এই পরিস্থিতিতে, সেখানকার মানবিক সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সময়ে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনার জন্য চেষ্টা চলছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গাজার ঘনবসতিপূর্ণ কিছু এলাকায় নতুন করে অভিযান শুরুর পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। এর অংশ হিসেবে প্রায় ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা সদস্যকে ডাকা হবে এবং বর্তমানে কর্মরত আরও ২০ হাজার রিজার্ভ সেনার চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হবে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে, গাজায় মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, বিশাল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
সামরিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা গাজা সিটির এমন কিছু অংশে অভিযান চালাবে, যেখানে আগে তারা যায়নি এবং তাদের ধারণা সেখানে হামাস এখনও সক্রিয় রয়েছে। ইতোমধ্যে গাজা সিটির জেইতুন ও জাবালিয়া এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে। খুব সম্ভবত আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এই অভিযানের চূড়ান্ত অনুমোদন আসতে পারে।
গাজা সিটি হামাসের প্রধান সামরিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। ইসরায়েলি সেনারা হামাসের বিশাল সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ককে লক্ষ্য করে অভিযান চালাবে। যদিও ইসরায়েল হামাসের শীর্ষ নেতাদের অনেককে হত্যা করেছে, তবুও সংগঠনটির কিছু অংশ এখনো সক্রিয় রয়েছে এবং তারা ইসরায়েলের দিকে রকেট হামলা চালাচ্ছে।
জানা গেছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই অভিযান শুরু হতে পারে। আগামী মাসের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার রিজার্ভ সেনা সদস্যকে ডাকা হবে, যা গত কয়েক মাসের মধ্যে সব থেকে বড় সেনা সমাবেশ।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বারবার বলেছেন, যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য হল জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা এবং হামাসসহ অন্যান্য জঙ্গিদের আর কখনোই ইসরায়েলের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে না দেওয়া।
গাজা সিটিতে সামরিক অভিযান আরও বড় করার পরিকল্পনার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে পুনরায় ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নেতানিয়াহু গত ৯ই আগস্ট জানান, এই অভিযান গাজা সিটি এবং সেখানকার কেন্দ্রগুলোতে চালানো হবে। বর্তমানে সেখানে বাস্তুচ্যুত হওয়া কয়েক লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে এবং সেখানে জরুরি অবকাঠামোর কিছু অবশিষ্ট অংশ বিদ্যমান।
সংবাদ সংস্থা এপির (AP) প্রতিনিধিরা সম্প্রতি দেখেছেন, কিছু মানুষ শহর ছেড়ে দক্ষিণের দিকে যাচ্ছে। তবে কতজন স্বেচ্ছায় এলাকা ছাড়বে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায়, তা দেখে তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। তাদের অনেকেই মনে করেন, বিমান হামলার কারণে গাজার কোনো এলাকাই এখন নিরাপদ নয়।
এদিকে, ইসরায়েলের রিজার্ভ সেনারা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে সরকার যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছে এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে।
জিম্মিদের পরিবার এবং প্রাক্তন সেনা ও গোয়েন্দা প্রধানরাও গাজা সিটিতে অভিযান সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেছেন। জিম্মিদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চান। তাদের আশঙ্কা, অভিযান বাড়লে গাজায় আটকে থাকা প্রায় ৫০ জন জিম্মির জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হবে। ইসরায়েলের ধারণা, এদের মধ্যে প্রায় ২০ জন এখনো জীবিত আছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের (Shin Bet) প্রাক্তন প্রধান ইয়োরাম কোহেন এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, হামাসকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “যদি কেউ কল্পনা করেন যে আমরা প্রতিটি সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করতে পারব, প্রতিটি সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে পারব এবং একইসঙ্গে আমাদের জিম্মিদেরও ফিরিয়ে আনতে পারব, তবে আমি মনে করি এটা অসম্ভব।”
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। এতে বেশিরভাগ বেসামরিক লোকসহ প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে অপহরণ করা হয়। যুদ্ধবিরতি বা অন্যান্য চুক্তির মাধ্যমে অনেক জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। হামাস জানিয়েছে, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে তারা বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেবে।
বর্তমানে কায়রোতে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে আলোচনা চলছে। গাজায় মানবিক সংকট নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইসরায়েলের ২২ মাসের অভিযানে এ পর্যন্ত ৬২,০০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হামাস-নিয়ন্ত্রিত সরকারের অংশ এবং এতে চিকিৎসা পেশাদাররা কাজ করেন। মন্ত্রণালয় নিহতদের মধ্যে কতজন বেসামরিক নাগরিক বা যোদ্ধা, সে হিসাব দেয়নি। তবে তাদের মতে, নিহতদের প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু। এছাড়া, জুন মাস থেকে অপুষ্টিজনিত কারণে ১৫৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ১১২ জন শিশু মারা গেছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস