ইরানকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি ইসরায়েলের! এরপর কী হতে পারে?

ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার হুমকি ইসরায়েলের, কী হতে পারে এরপর?

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে সম্ভবত হত্যার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এমন পরিস্থিতিতে তেহরানে সরকার পরিবর্তনের সম্ভবনা দেখা দিলে দেশটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এবং এর ফলে পুরো অঞ্চলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের সরকার যদি ক্ষমতা হারায়, তবে সেখানে দীর্ঘদিনের পুরোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলো মাথা চাড়া দিতে পারে। এর ফলস্বরূপ, ইরান খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যেতে পারে এবং চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এক বক্তব্যে জানান, ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে সহজে ‘নিশানা’ বানানো সম্ভব। যদিও তিনি এখনই তাকে হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা করছেন না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও খামেনিকে ‘টার্গেট’ করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। তার মতে, সর্বোচ্চ নেতার মৃত্যু “সংঘাত বাড়াবে না, বরং এটি বন্ধ করবে”।

এদিকে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল ক্যাটজ সম্প্রতি বলেছেন, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের একটি হাসপাতালে আঘাত হানার পর খামেনিকে “আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায় না”।

নব্বই মিলিয়নের বেশি মানুষের আবাসস্থল ইরান, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। গত একশ বছর ধরে দেশটির সীমান্ত মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের বসবাস সত্ত্বেও ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটি সীমান্তগুলো ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে ইসরায়েলি ও মার্কিন কর্মকর্তাদের এমন মন্তব্যের পর অনেকেই ধারণা করছেন, খামেনিকে হত্যা করা হলে ইরান সম্ভবত একটি কঠিন পরিস্থিতির দিকে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলস্বরূপ regime collapse বা সরকারের পতন এমনকি গৃহযুদ্ধও শুরু হতে পারে।

আশি বছর বয়সী খামেনি ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর থেকে কঠোর ইসলামিক আইন প্রয়োগ করে তিনি তার ক্ষমতা সুসংহত করেছেন। সামাজিক স্বাধীনতা চেয়ে হওয়া বিভিন্ন প্রতিবাদ কঠোরভাবে দমন করেছেন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রক্সি মিলিশিয়াদের মাধ্যমে ইরানের প্রভাব বিস্তার করেছেন।

খামেনির ক্ষমতার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তখন তার উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই অনিশ্চয়তা আরও বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

জানা যায়, ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে আজীবনকালের জন্য নির্বাচিত করেন ৮৮ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ পরিষদ। যদিও তিনি সরাসরি কোনো উত্তরসূরি মনোনীত করেন না। কে খামেনির স্থলাভিষিক্ত হবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি অসন্তুষ্ট বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সুযোগ নিতে পারে।

ইতিমধ্যে ইসরায়েল ইরানের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে দেশটির সরকার দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।

ওয়াশিংটন ডিসির কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিটা পার্সি বলেন, যদি regime change হয়, তাহলে খামেনির স্থলাভিষিক্ত করার জন্য ইসরায়েল অথবা যুক্তরাষ্ট্রের কাউকে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সৈন্য পাঠাতে হতে পারে।

ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েল সম্ভবত রেজা পাহলভিকে সমর্থন করতে পারে। তিনি ১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত ইরানের শাহের ছেলে এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। পাহলভি ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, যা প্রবাসী ইরানীদের মধ্যে কারো কারো কাছে প্রশংসিত হলেও অনেকের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যদি সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যা করা হয় এবং অভিভাবক পরিষদ উত্তরসূরি নির্বাচনে বিলম্ব করে, তাহলে অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। পার্সি আরও বলেন, খামেনিকে হত্যার সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে regime collapse বা সরকারের সম্পূর্ণ পতন। এমনটা হলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হতে পারে।

ইরানে পার্সিয়ান, আজেরি, আরব, বেলুচ ও কুর্দিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। খামেনির দীর্ঘ শাসনের সময় ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কিছু গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য দেখালেও জাতিগত ও নাগরিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, সংখ্যালঘুদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পর্যাপ্ত আবাসন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের বসবাস করা অঞ্চলে ক্রমাগত বিনিয়োগের অভাবে দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতা বেড়েছে।

ইরানের জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ হলো আজেরি। এই শিয়া সম্প্রদায়টি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং সুসংহত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হলেও তারা বিভিন্ন সময় বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এছাড়া, প্রায় ৪০ লাখ আরবও বিভিন্ন সময়ে প্রান্তিকতার শিকার হয়েছে। বেলুচ ভাষায় কথা বলা বেলুচ সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এই সুন্নি সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রতিবেশী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেও বসবাস করে। ফলে, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাত সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ারও সম্ভবনা রয়েছে।

একটি বেলুচ সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আর্মি অব জাস্টিস’ ইসরায়েলের ইরান আক্রমণের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এটা স্পষ্ট যে বর্তমান হামলা ইরানের ওপর নয়, বরং ভেলয়াত-ই-ফাকিহ (শাসক) regimes এর ওপর। ইরানের জনগণের জন্য এই শূন্যতাকে কাজে লাগানোর এটাই উপযুক্ত সময়।”

ইরানের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ কুর্দি। তারা মূলত ইরাক ও তুরস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, তারা “গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসা বৈষম্যের” শিকার।

এছাড়াও, একটি নির্বাসিত গোষ্ঠী ‘মুজাহিদিন-ই-খালক’ (MeK)। এক সময় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত এই গোষ্ঠীর সঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর ইরানবিরোধী রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইরান তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত করে ১৯৮০-এর দশকে একাধিক হামলার জন্য দায়ী করে। যদিও MeK এই অভিযোগ অস্বীকার করে।

বর্তমানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা অন্যতম সুসংগঠিত বিরোধী গোষ্ঠী এটি। তবে তাদের সহিংস অতীত এবং ইরাকের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন করার কারণে ইরানিদের মধ্যে তাদের তেমন কোনো সমর্থন নেই।

পার্সি বলেন, ইরানের সরকার যদি পতন হয়, তাহলে “ইসরায়েল এবং সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করবে”। এর ফলে রাষ্ট্রের অবশিষ্ট অংশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে।

নন-ভায়োলেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর ডেমোক্রেসির নির্বাহী পরিচালক ও ইরানের সাবেক আইনপ্রণেতা ফাতেমা হাকিকাতজু বর্তমান সরকারের বিরোধীতা করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, বর্তমান শাসনের পতনে ইরানে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *