গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত অন্তত ৭০ জন, নিহতদের মধ্যে ২২ জন শিশু।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। বুধবারের এই হামলায় আহত হয়েছে আরও অনেকে।
স্থানীয় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ২২ জন শিশু রয়েছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাসকে পরাজিত না করা পর্যন্ত গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানানোর একদিন পরেই এই হামলা চালানো হয়।
গাজার উত্তরাঞ্চলে জাবালিয়ায় চালানো হামলায় নিহত হয়েছে অন্তত ৫০ জন, যাদের মধ্যে ২২ জনই শিশু। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং হাসপাতাল সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সোমবার হামাস একজন ইসরায়েলি-মার্কিন জিম্মিকে মুক্তি দেয়। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, এর ফলে হয়তো যুদ্ধবিরতির পথ খুলতে পারে।
একই সময়ে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবে সফর করছিলেন, যা ছিল উপসাগরীয় দেশগুলোতে তাঁর কয়েক দিনের সফরের অংশ।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তবে তারা মঙ্গলবার রাতে জাবালিয়ার বাসিন্দাদের এলাকা ছাড়ার জন্য সতর্ক করে, কারণ সেখানে রকেট লঞ্চারসহ জঙ্গি অবকাঠামো রয়েছে বলে তারা জানায়।
জাবালিয়ায় উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া শিশুদের মরদেহ উদ্ধারের জন্য হাতুড়ি ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে কাজ চালিয়ে যান।
মোবাইল ফোনের আলোয় তারা কাজ করছিলেন।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় তাদের অভিযান আরও জোরদার করতে কয়েক দিন পরই সেখানে প্রবেশ করবে।
তাদের লক্ষ্য হলো ‘হামাসকে ধ্বংস করা’।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় অনেকেই আশা করেছিলেন, এর মাধ্যমে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে অথবা মানবিক সহায়তা আবার চালু হতে পারে।
কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি।
বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ চলছে, যা ইতোমধ্যে তিন মাস পার করেছে।
২০২৩ সালে হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে ১,২০০ জনকে হত্যা করার পর এই যুদ্ধের সূচনা হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় এ পর্যন্ত ৫২,৯২৮ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
তবে নিহতদের মধ্যে কতজন যোদ্ধা, তা তারা জানায়নি।
মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, ১৮ই মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে প্রায় ৩,০০০ জন নিহত হয়েছে।
ইসরায়েলি অভিযানের কারণে গাজার বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সেখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার খান ইউনিসে একটি হাসপাতালে চালানো হামলায় নিহত হন হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ছোট ভাই মোহাম্মদ সিনওয়ার।
গত অক্টোবরে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে হত্যা করে।
সামরিক বাহিনী অবশ্য এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তারা শুধু বলেছে, হাসপাতালের নিচে থাকা হামাসের ‘কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার’-কে তারা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
গাজার একজন সিনিয়র স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বুধবার জানিয়েছেন, হামলার কারণে অ্যাম্বুলেন্সগুলো এখন হাসপাতালে যেতে পারছে না এবং হাসপাতালের অস্ত্রোপচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফিল্ড হাসপাতালের মহাপরিচালক ড. মারওয়ান আল-হামস জানান, হামলায় হাসপাতালের পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং উঠান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের জন্য এলাকা মেরামতের জন্য আনা একটি বুলডোজারকেও আঘাত করেছে।
তিনি বলেন, “এই ক্ষতিগুলো মেরামত না করা পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালের বেশিরভাগ বিভাগ বন্ধ রাখতে হবে।”
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামলার যে কারণ বলা হয়েছে, সে বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই বলেও তিনি জানান।
এদিকে, আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, ইসরায়েল অবরোধ তুলে না নিলে এবং সামরিক অভিযান বন্ধ না করলে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন-এর (Integrated Food Security Phase Classification) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫ লাখ ফিলিস্তিনি অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং আরও ১০ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নেতানিয়াহুর ত্রাণ সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ এবং ‘একটি বড় ধরনের মানবিক সংকট’ সৃষ্টি করেছে বলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার রাতে টিএফ১ জাতীয় টেলিভিশনে তিনি বলেন, “আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার আজ যা করছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সেখানে কোনো ওষুধ নেই, আহতদের বের করা যাচ্ছে না, এমনকি ডাক্তাররাও প্রবেশ করতে পারছেন না।”
গত মাসে মিশরে আহত ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ম্যাক্রোঁ মানবিক ত্রাণ পাঠানোর জন্য গাজার সীমান্ত পুনরায় খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “এরপর, হ্যাঁ, আমাদের হামাসকে নিরস্ত্র করতে, জিম্মিদের মুক্ত করতে এবং একটি রাজনৈতিক সমাধান তৈরি করতে হবে।”
জবাবে নেতানিয়াহু ম্যাক্রোঁকে একটি চরমপন্থী সংগঠনের ‘মিথ্যা প্রচারণার প্রতিধ্বনি’ বলে মন্তব্য করেন।
গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ জীবন ধারণের জন্য বাইরের সাহায্যনির্ভর।
ইসরায়েলের ১৯ মাসব্যাপী সামরিক অভিযানে সেখানকার খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেখা দিয়েছে এবং যা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম আকাশছোঁয়া।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় দাতব্য সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সরবরাহ করা খাবারের পরিমাণ এপ্রিলের শেষের দিকের দৈনিক ১০ লাখ থেকে কমে বর্তমানে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
দাতব্য রান্নাঘরগুলো গাজার অধিকাংশ মানুষের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল, কিন্তু সরবরাহ ফুরিয়ে যাওয়ায় সেগুলো দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক অফিসের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে অন্তত ১১২টি রান্নাঘর (মোটের ৬০ শতাংশের বেশি) বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্তমানে মাত্র ৬৮টি রান্নাঘর চালু আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) জানিয়েছে, তাদের কাছে তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য মজুত নেই।
বর্তমানে তাদের কাছে যা আছে, তা দিয়ে মাত্র ৫০০ শিশুর চিকিৎসা করা সম্ভব।
অথচ, গত কয়েক সপ্তাহে হাজার হাজার শিশুর অপুষ্টি ধরা পড়েছে।
ইসরায়েল বলছে, হামাসকে অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দিতে এবং অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্যই এই অবরোধ।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, সম্প্রতি দুই মাসের যুদ্ধবিরতির সময় প্রচুর পরিমাণে ত্রাণ আসায় বর্তমানে সেখানে পর্যাপ্ত খাবার মজুদ রয়েছে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস।