গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান প্রাক্তন ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের, নতুন পদক্ষেপের ইঙ্গিত নেতানিয়াহুর।
জেরুজালেম থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইসরায়েলের প্রাক্তন সেনা ও গোয়েন্দা প্রধানেরা আওয়াজ তুলেছেন। একই সময়ে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজায় আরও সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং বিধ্বস্ত অঞ্চলটিতে ইসরায়েলি সরকার তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছে।
গাজায় খাদ্য বিতরণের সময় ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মঙ্গলবার জানিয়েছেন, খাদ্য সংগ্রহের সময় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে আরও কিছু ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে, গাজায় ত্রাণ বিতরণের প্রক্রিয়া উন্নত করতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নতুন চুক্তি ঘোষণা করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বিভাগ, যারা গাজায় মানবিক সহায়তা সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে।
যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো প্রাক্তন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের প্রধান, মোসাদ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত প্রায় তিন মিনিটের একটি ভিডিও বার্তায় তাঁরা এই যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানান। তাঁদের মতে, সরকারের চরমপন্থী সদস্যরা এই সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করে দেশকে “জিম্মি” করে রেখেছে।
শিন বেটের প্রাক্তন প্রধান আমি আয়ালোন ভিডিও বার্তায় বলেন, “এটি ইসরায়েল রাষ্ট্রকে তার নিরাপত্তা এবং পরিচয় হারানোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।”
অন্যদিকে, মোসাদের প্রাক্তন প্রধান ইয়োরাম কোহেন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্যকে “কল্পনা” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “যদি কেউ মনে করেন যে আমরা প্রত্যেক সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করতে পারব, প্রত্যেকটি সুড়ঙ্গপথ ও অস্ত্রাগার ধ্বংস করতে পারব, একইসঙ্গে জিম্মিদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারব, তাহলে আমি মনে করি এটা অসম্ভব।”
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সোমবার ঘোষণা করেছেন যে তিনি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকবেন। বৈঠকে গাজায় যুদ্ধের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সামরিক বাহিনীকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে গাজায় আরও কঠোর সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
নেতানিয়াহু তাঁর যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকার কথা জানিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে হামাসকে পরাজিত করা, সকল জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া এবং গাজা যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করা।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম সূত্রে খবর, মঙ্গলবার এই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বৈঠকে নেতানিয়াহু ও সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আইয়াল জামিরের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে বলে জানা গেছে। নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীকে পুরো গাজা অঞ্চল দখলের জন্য চাপ দিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। যদিও ইতিমধ্যে তারা গাজার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণে জিম্মিদের জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, গাজায় মানবিক সংকট আরও গভীর হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের একঘরে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জামির এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন এবং তা অনুমোদিত হলে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন।
মে মাস থেকে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র, আকাশ থেকে ফেলা ত্রাণ এবং ত্রাণ বহরের দিকে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কয়েকশ’ মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা শুধুমাত্র সতর্কতামূলক গুলি ছুড়েছে এবং হতাহতের সংখ্যা নিয়ে তাদের ভিন্ন মত রয়েছে।
গাজায় ত্রাণ সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বিভাগ (COGAT) সামাজিক মাধ্যম এক্সে (X) লিখেছে, “গাজায় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ও নিয়ন্ত্রিতভাবে পণ্য প্রবেশ করানো হবে।”
তাদের মতে, এর লক্ষ্য হল ‘জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে গাজায় আরও বেশি ত্রাণ সরবরাহ করা’।
এই পরিকল্পনার জন্য সীমিত সংখ্যক স্থানীয় ব্যবসায়ীকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাঁরা খাদ্যপণ্য, শিশুদের খাবার, ফল, সবজি ও স্বাস্থ্যবিধির সামগ্রী বিক্রি করতে পারবেন, যার দাম ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার মধ্যাঞ্চলে এবং দক্ষিণাঞ্চলে জরুরি ত্রাণ চেয়ে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায়। এতে কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছে।
নাসির হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ১৯ জন গাজার দক্ষিণে নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন মোরাগ করিডোর এবং তেইনা এলাকার কাছে ত্রাণ সংগ্রহের সময় নিহত হন। খান ইউনিসের পূর্বে অবস্থিত গাজা মানবিক সহায়তা ফাউন্ডেশন কেন্দ্রের (Gaza Humanitarian Foundation hub) কাছ থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে এই ঘটনা ঘটে।
উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয় হামাস সরকারের অধীনে কাজ করে এবং তারা জঙ্গি ও বেসামরিক লোকের মধ্যে পার্থক্য করে না। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা হতাহতের তথ্যের জন্য তাদের ওপর নির্ভর করে।
অন্যদিকে, আল-আওদা হাসপাতাল জানিয়েছে, মঙ্গলবার ইসরায়েলি সেনারা জিএইচএফ (GHF) কর্তৃক পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ভিড়ের ওপর হামলা চালালে ৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। যদিও জিএইচএফ জানিয়েছে, মঙ্গলবার তাদের কেন্দ্রে কোনো ঘটনা ঘটেনি।
খান ইউনিসের বাসিন্দা মোহাম্মদ কাসাস বলেন, তাঁর সন্তানেরা এত ক্ষুধার্ত যে তিনি ত্রাণ ট্রাকে হামলা করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, “আমার ছোট ছোট বাচ্চা আছে, তাদের আমি কীভাবে খাওয়াবো? কারও কোনো দয়া নেই। এটা যেনো কেয়ামতের দৃশ্য। আমরা লড়লে খাবার পাই, না লড়লে কিছুই পাই না।”
যখন ট্রাকগুলো চলে যাচ্ছিল, পুরুষেরা সেগুলোর ওপর উঠে যায় এবং অবশিষ্ট খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করে। কাসাস বলেন, “পরিস্থিতি খুবই কঠিন এবং আমরা একটি ব্যবস্থার প্রত্যাশা করছি। কেউ কেউ ২০০ কেজি (৪৪১ পাউন্ড) নিয়ে বাড়ি ফেরে, আবার কেউ ১ কেজি (৩৫ আউন্স)। এটা একটা মাফিয়া চক্রের মতো।”
ত্রাণ ট্রাক থেকে খাবার পাওয়ার জন্য নিরন্তর চেষ্টার পর, পুরুষদের কাঁধে করে আটা বা ময়দার বস্তা এবং আহত ও মৃতদেহ নিয়ে ফিরতে দেখা যায়।
খান ইউনিসের বাসিন্দা ইউসুফ আবু মোর বলেন, ত্রাণ বিতরণের এই ব্যবস্থা মৃত্যুর ফাঁদের মতো। তিনি বলেন, “এই ত্রাণ অপমান ও রক্তে মাখা।” তিনি আরও যোগ করেন, ত্রাণপ্রার্থীরা হয় গুলির শিকার হচ্ছেন, না হয় ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ভিড়ের মধ্যে ত্রাণ ট্রাকের চাপায় মারা যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের অবরোধ ও সামরিক অভিযানের কারণে নিরাপদে ত্রাণ সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের প্রায় ২২ মাস পর এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েলের ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। গাজায় জিম্মিদের পরিবারগুলোও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় রয়েছে, তবে তারা হামাসকে দায়ী করছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি দেশ গাজার ওপর ত্রাণ ফেলছে। জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, এই ধরনের ত্রাণ সরবরাহ বাসিন্দাদের জন্য ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ এবং ট্রাকের তুলনায় এতে অনেক কম ত্রাণ সরবরাহ করা যায়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস