গাজায় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব, আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীরা।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন আরব মধ্যস্থতাকারীরা। প্রস্তাবনায় পাঁচ থেকে সাত বছর পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি এবং অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, বুধবার রাতের হামলায় গাজায় অন্তত নয় জন নিহত হয়েছে।
মিশরের একজন কর্মকর্তা এবং হামাসের একজন প্রতিনিধির বরাত দিয়ে জানা গেছে, কাতার ও মিশর যৌথভাবে এই প্রস্তাব তৈরি করছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজা থেকে ধীরে ধীরে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তারা মিডিয়াকে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি।
গত মাসে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয় ইসরায়েল। তারা জানিয়েছে, সব জিম্মিকে ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত এবং হামাসকে হয় নির্মূল অথবা নিরস্ত্র করে নির্বাসনে পাঠানো না পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। একইসঙ্গে ইসরায়েল গাজায় খাদ্যসহ সব ধরনের আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে এবং তাদের কিছু অংশ অনির্দিষ্টকালের জন্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
হামাস জানিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি, ইসরায়েলের সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার এবং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে এখনো তাদের কাছে থাকা জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি আছে। হামাস প্রতিনিধি দল এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য মঙ্গলবার কায়রোতে পৌঁছেছে।
প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি পাঁচ থেকে সাত বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে, যেখানে আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা থাকবে। হামাস এতে রাজি হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজার শাসন পরিচালনার জন্য টেকনোক্র্যাটদের একটি কমিটি গঠন করা হবে।
হামাস নেতারা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা থাকলে তারা দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতি চান। সেক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক অথবা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই নিশ্চয়তা দিতে পারে।
মিশরের ওই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি তুরস্কও এই আলোচনায় যোগ দিয়েছে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে হামাসকে গাজায় তাদের প্রভাব বজায় রাখতে বা পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ করতে দেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থার সঙ্গে তারা রাজি নয়। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও ইসরায়েলের অবস্থানকে সমর্থন জানানো হয়েছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র, উভয়ই হামাসের কাছে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি চাইছে, যেখানে তারা কিছু জিম্মিকে মুক্তি দেবে এবং এর বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেবে। তবে হামাস এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ইসরায়েলের দখলে থাকা পর্যন্ত তারা অস্ত্র ত্যাগ করবে না।
হামাস নেতারা জানিয়েছেন, তারা নেতানিয়াহু এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থা রাখতে পারছে না, কারণ তারা ইতোমধ্যেই আগের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে দিয়েছে, যার মাধ্যমে ৩০ জনের বেশি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
মিশরের কর্মকর্তাদের ধারণা, আগামী মাসে ট্রাম্প ওই অঞ্চলে আসার আগে একটি সমঝোতা হতে পারে। ট্রাম্প ১৩ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করবেন।
গাজা শহরে ইসরায়েলি হামলায় ৯ জন নিহত হয়েছে।
গত মাসে ইসরায়েল গাজাজুড়ে বোমা হামলা চালিয়ে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়। এতে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ইসরায়েলি বাহিনী সীমান্ত বরাবর একটি বাফার জোন তৈরি করেছে এবং রাফা শহর ঘিরে ফেলেছে। বর্তমানে গাজার প্রায় ৫০ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মার্চ মাস থেকে ইসরায়েল খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও অন্যান্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের দাবি, এর মাধ্যমে হামাসকে জিম্মিদের মুক্তি দিতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তবে ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং বেশিরভাগ মানুষ দিনে এক বেলা বা তার চেয়েও কম খাবার খাচ্ছে।
গাজা শহরের একটি স্কুল- আশ্রয়কেন্দ্রে রাতভর হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছে। হামাস পরিচালিত সরকারের অধীনে কাজ করা বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীরা একই এলাকার দুটি বাড়িতে হামলায় আরও চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও অনেকে আটকা পড়েছে বলে তারা জানিয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তাদের দাবি, তারা শুধুমাত্র জঙ্গিদের লক্ষ্য করে হামলা চালায় এবং বেসামরিক হতাহতের জন্য হামাসকে দায়ী করে। কারণ জঙ্গিরা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় লুকিয়ে থাকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৫১,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তবে নিহতদের মধ্যে কতজন জঙ্গি বা বেসামরিক লোক ছিল, তা তারা জানায়নি। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা প্রায় ২০,০০০ জঙ্গিকে হত্যা করেছে, তবে এর কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালায়। এতে বেশিরভাগ বেসামরিক লোকসহ প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে অপহরণ করা হয়। হামাসের কাছে এখনো ৫৯ জন জিম্মি রয়েছে, যাদের মধ্যে ২৪ জন জীবিত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস