তুরস্কে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালীন সময়ে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরাম ইমামোগলুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই ঘটনায় দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
একই দিনে তার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) তাকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার কথা ছিল, আর সেই সময়েই এই গ্রেফতারি হয়।
ইস্তাম্বুলের মেয়র একরাম ইমামোগলু তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তিনি একটি অপরাধী সংগঠন পরিচালনা করেছেন, ঘুষ নিয়েছেন, এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
এছাড়াও, তার দলের আরও অনেক সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদেরও এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। গত বছরের স্থানীয় নির্বাচনের আগে একটি বামপন্থী রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে সহযোগিতা করার অভিযোগে ইমামোগলুর বিরুদ্ধে “সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তার” অভিযোগও আনা হয়েছে।
সরকারপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ইমামোগলুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগই যথেষ্ট। যদিও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগেও আরও কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে, তবে মেয়রকে সেই তালিকায় রাখা হয়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি-কে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচন করার সুযোগ করে দেওয়া হবে। এর ফলে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।
গ্রেফতারের পর ইমামোগলু এক বিবৃতিতে বলেছেন, তার এই আটক “কেবল তুরস্কের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচার এবং অর্থনীতির প্রতি আস্থাকেও দুর্বল করেছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “গণতন্ত্রের একজন সমর্থক এবং জনগণের শক্তিতে বিশ্বাসী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, সত্যের জয় হবে।”
ইমামোগলুর মুখপাত্র মুরাত ওঙ্গুনও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে, যার কোনো প্রমাণ নেই!”
মেয়রের এই আকস্মিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে তুরস্কে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসছেন এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলী ইয়ারলিকায়া জানিয়েছেন, বিক্ষোভের কারণে আরও ৩২৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এর আগে, বিক্ষোভের কারণে আরও ৩৪৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
তুর্কি কর্মকর্তারা ইমামোগলু এবং তার দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের কথা অস্বীকার করেছেন। তবে সরকারের এমন দাবি সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, জনসমাগমস্থল এবং ইস্তাম্বুলের সিটি হলের বাইরে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
সরকার বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করলেও তা উপেক্ষা করে মানুষজন রাস্তায় নেমে এসেছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান এই বিক্ষোভকে “রাস্তার সন্ত্রাস” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “বামপন্থী সংগঠন ও দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ইচ্ছার ওপর আঙুল তোলার দিন শেষ… আমরা সিএইচপি এবং তাদের সমর্থকদের উস্কানি দিয়ে জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতে বা আমাদের জাতির শান্তি নষ্ট করতে দেব না।”
ইমামোগলুকে গ্রেফতারের দিনেই সিএইচপির প্রায় ১৫ লাখ সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাকে সমর্থন করার জন্য ভোট দেন। এই নির্বাচনে ইমামোগলু ছিলেন দলের একমাত্র প্রার্থী, যা তার প্রতি জনগণের সমর্থনের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমামোগলুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এরদোগানকে নির্বাচনে হারাতে পারেন। তুরস্কে ২০২৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, তবে এর আগে নির্বাচন হতে পারে এমন সম্ভাবনাও রয়েছে।
২০১৯ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে ইমামোগলু প্রথমবার জয়লাভ করেন। তবে এরদোগানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির আপত্তির কারণে সেই নির্বাচন বাতিল করা হয়।
পরে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। সম্প্রতি, ইস্তাম্বুলের একটি আদালত তাকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে, যার বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন।
সিএইচপির নেতা ওজগুর ওজেল এরদোগান সরকারকে নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে ইমামোগলুকে আটক করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। ইমামোগলুকে গ্রেফতারের আগে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় তার ডিগ্রি বাতিল করে দেয়, ফলে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
কারণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একটি স্বীকৃত ডিগ্রি থাকা আবশ্যক।
ওজেল বলেন, “একরাম ইমামোগলুর একমাত্র অপরাধ হলো জনমত জরিপে তার এগিয়ে থাকা।” তিনি আরও বলেন, মেয়রের এই গ্রেফতার “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তাকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।”
ইমামোগলুর গ্রেফতারের পর বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেক লোক বলেছেন, এই ঘটনা তাদের ভোট দিতে উৎসাহিত করেছে। তারা জানান, এর মাধ্যমে তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চান।
সিএইচপি দলের বাইরের লোকদেরও নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। দলের সদস্যরা আশা করছেন, এতে ভোটার উপস্থিতি আরও বাড়বে।
আঙ্কারার মেয়র মানসুর ইয়াভাস ইমামোগলুর গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে বলেন, “আমরা আমাদের বিচার ব্যবস্থার জন্য লজ্জিত।” তিনি আরও বলেন, “টিভির আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি এমন সব অভিযোগ, যা আইনজীবীরাও পাননি।
এর থেকে স্পষ্ট হয়, এই পুরো ঘটনাটি কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান