শিল্পকলার জগতে অভিনবত্বের ছোঁয়া: বিশ্বের সেরা কিছু আর্ট হোটেল
আজকাল ভ্রমণের ধারণাই যেন বদলে যাচ্ছে।
শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়, মানুষ চায় এমন অভিজ্ঞতা যা মনকে স্পর্শ করে, সংস্কৃতিকে অনুভব করতে সাহায্য করে।
আর এই পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ‘আর্ট হোটেল’ – যেখানে শিল্পের ছোঁয়ায় তৈরি হয় থাকার এক ভিন্ন জগৎ।
জাপানের একটি নির্জন দ্বীপ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, এই ধরনের হোটেলগুলো এখন ভ্রমণকারীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
জাপানের ছোট্ট দ্বীপ নাওশিমার কথা ভাবুন।
ওকায়ামা থেকে ট্রেনে করে প্রায় ৫০ মিনিটের পথ পেরিয়ে, একটি ফেরিতে চড়ে আপনি পৌঁছে যাবেন মিয়ানৌরাতে।
সেখানে ইয়ায়োই কুসামার তৈরি করা বিশাল হলুদ রঙের কুমড়ার ভাস্কর্যটি আপনাকে স্বাগত জানাবে।
এরপরই শুরু হবে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, যা আপনাকে নিয়ে যাবে বেনেস হাউস মিউজিয়ামের জগতে।
১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেনেস হাউস মিউজিয়াম, সাধারণ বিলাসবহুল হোটেলের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
এখানে আরাম-আয়েশের চেয়ে শিল্পের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয় বেশি।
এই হোটেলে অতিথিরা শুধু একটি কক্ষে থাকেন না, বরং তারা একটি জাদুঘরের অংশ হয়ে যান।
রাতে যখন দিনের আলো কমে আসে, তখন হোটেলের অতিথিরা জ্যাঁ-মিশেল বাসকুইয়াট এবং ওয়াল্টার ডি মারিয়ার মতো শিল্পীদের কাজগুলো উপভোগ করতে পারেন।
বেনেস হাউস মিউজিয়াম তৈরির পেছনে ছিলেন দুই স্বপ্নদ্রষ্টা – ফুকুতাকে পাবলিশিং-এর প্রতিষ্ঠাতা তেৎসুহিকো ফুকুতাকে এবং নাওশিমার মেয়র চিকাতসুগু মিয়াকি।
তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় এই দ্বীপটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
প্রিটজকার পুরস্কার বিজয়ী স্থপতি তাদাও আনদো’র নকশায় তৈরি এই হোটেলে প্রকৃতি, স্থাপত্য এবং শিল্পকর্মের এক অপূর্ব মিলন ঘটেছে।
৬১টি গেস্ট রুমের প্রতিটি থেকে সমুদ্রের দৃশ্য দেখা যায়, যা শিল্পকর্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এক অসাধারণ পরিবেশ সৃষ্টি করে।
জাপানের ‘মা’ (শূন্যস্থান) এবং ‘ওয়াবি-সাবি’ (অসম্পূর্ণতার সৌন্দর্য) ধারণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, বেনেস হাউস তৈরি হয়েছে।
এখানকার প্রতিটি স্থান তৈরি করা হয়েছে গভীর চিন্তাভাবনার জন্য, যেখানে অতিথি অতিরিক্ত আরামের পরিবর্তে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারে।
নাওশিমার সাফল্যের পর, এর প্রতিবেশী দ্বীপগুলোতেও এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।
তেশিমার মতো দ্বীপে তৈরি হয়েছে ড্রপলেট আকৃতির একটি আর্ট মিউজিয়াম, আবার ইনুজিমায় পরিত্যক্ত কপার রিফাইনারিটিকে (copper refinery) রূপান্তরিত করে তৈরি করা হয়েছে সেইরেনশো আর্ট মিউজিয়াম।
বিশ্বজুড়ে এখন এই আর্ট হোটেলের ধারণা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ব্রাজিল, গ্রিস থেকে পর্তুগাল – বিভিন্ন দেশে এই ধরনের হোটেল তৈরি হচ্ছে।
যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে অবস্থিত ‘দ্য সিলো’ হোটেলটি একটি পুরনো শস্য ভাণ্ডারকে নতুন করে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
এখানে প্রতিটি কক্ষে রয়েছে সমসাময়িক আফ্রিকান শিল্পকর্ম এবং জানালা থেকে টেবল মাউন্টেন ও সমুদ্রের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।
ব্রাজিলের মিনাস গেরাইসে অবস্থিত ক্লারা আর্ট রিসোর্ট, ইনহোটিম ইনস্টিটিউটের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে।
এখানে ১৪০ হেক্টরেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিভিন্ন শিল্পীর প্রায় ১,৮৬২টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়।
গ্রিসে, ফি ব্লু প্যালেস হোটেল বেনাকি মিউজিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের লবিতে মিউজিয়ামের কিছু শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে।
পর্তুগালের লিসবনে অবস্থিত Museu de Arte Contemporânea Armando Martins (MACAM) হোটেলটিও একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদকে রূপান্তরিত করে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে হোটেলের ৬৪টি কক্ষে শিল্পকর্ম দেখা যায়।
নিউ ইয়র্ক সিটিতে ২০২৯ সালে তৈরি হতে যাওয়া ক্লাইমেট মিউজিয়াম টাওয়ারও এই ধারার একটি উদাহরণ।
এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর প্রদর্শনী এবং অতিথিদের জন্য বিশেষ স্থান থাকবে, যা পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
আর্ট হোটেলের এই ধারণা প্রমাণ করে যে, ভ্রমণ এখন শুধু গন্তব্যের সৌন্দর্য উপভোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি সংস্কৃতি ও শিল্পের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক অসাধারণ সুযোগ।
যারা একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা ভালোবাসেন, তাদের জন্য এই ধরনের হোটেলগুলো হতে পারে আদর্শ ঠিকানা।
তথ্য সূত্র: ট্র্যাভেল এন্ড লেজার