শিরোনাম: প্রযুক্তি জগতে জাপানের ‘ফ্যাক্স-যন্ত্রের’ মায়া: ডিজিটাল রূপান্তরে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
জাপান, একসময় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথিকৃৎ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিল। সনি, টয়োটা, প্যানাসনিকের মতো জায়ান্ট কোম্পানিগুলো বিশ্বকে উপহার দিয়েছে ওয়াকম্যানের মতো উদ্ভাবন, দিয়েছে মারিও ব্রোস-এর মতো গেমিং অভিজ্ঞতা।
কিন্তু আধুনিক বিশ্বে, যখন ডিজিটাল প্রযুক্তির জয়জয়কার, তখনো জাপানে টিকে আছে ফ্যাক্স মেশিন, ফ্লপি ডিস্ক এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারের সিল (হ্যাংকো)। এই চিত্রটি দেখলে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে জাপানের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
আধুনিকতার এই যুগে, যেখানে উন্নত দেশগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করেছে, সেখানে জাপানের এই পশ্চাৎপদতা সত্যিই বিস্ময়কর। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়, যখন ডিজিটাল সরঞ্জামগুলির অভাবে সরকারি কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল, তখন এই দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য একটি বিশেষ সংস্থা (Digital Agency) তৈরি করতে হয়েছিল।
আসলে, নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই জাপানের প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রা কিছুটা থমকে যায়। একসময় হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিতে দক্ষতা দেখালেও, সফটওয়্যার ও পরিষেবা খাতে তারা পিছিয়ে পড়ে।
এর পেছনে ছিল বেশ কয়েকটি কারণ। যেমন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে কম বিনিয়োগ, প্রকৌশলীদের বিদেশি কোম্পানিতে চলে যাওয়া, ডিজিটাল জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীর অভাব ইত্যাদি। তাছাড়া, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর নিজস্ব পদ্ধতিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করত, ফলে সমন্বিত কোনো রূপান্তর ঘটেনি।
জাপানের সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। ঝুঁকি এড়িয়ে চলা, প্রবীণদের অগ্রাধিকার এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো বিষয়গুলো উদ্ভাবনে বাধা সৃষ্টি করেছে। বয়স্ক জনসংখ্যার আধিক্য প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে অনীহা তৈরি করেছে, কারণ তারা নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ডিজিটাল জালিয়াতির বিষয়ে বেশি সন্দিহান ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা নতুন প্রযুক্তি কেনার পরিবর্তে ফ্যাক্স মেশিনের ওপরই নির্ভর করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। অন্যদিকে, ব্যাংক বা হাসপাতালের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দৈনিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় ডিজিটাল রূপান্তরে যেতে দ্বিধা বোধ করত।
ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে জাপানের এই পিছিয়ে থাকার ফলস্বরূপ, এখনো অনেক সরকারি কাজে কাগজের ব্যবহার হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা বা আবাসনের জন্য আবেদন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও traditional পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হয়।
তবে, কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি পরিবর্তনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবে সরকারি কার্যক্রম যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তখন ডিজিটাল রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ২০২০ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, হাতে লেখা ফ্যাক্স বা ইমেলের পরিবর্তে অনলাইনে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয়েছিল।
জাপানের এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে। আমাদের দেশেও এখনো অনেক সরকারি ও বেসরকারি অফিসে সনাতন পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়। ডিজিটাল স্বাক্ষর এবং ই-ফাইলিংয়ের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এখনো সীমিত।
জাপানের মতো, আমাদেরও সরকারি পর্যায়ে ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে, প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।
জাপানের ডিজিটাল এজেন্সি এখন ফ্লপি ডিস্কের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বিভিন্ন সরকারি সিস্টেমে এক হাজারেরও বেশি নিয়ম পরিবর্তন করেছে। ডিজিটাল রূপান্তরের এই প্রক্রিয়া সহজ ছিল না, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে এর বিরোধিতা করা হয়েছিল।
ডিজিটাল রূপান্তরের এই পথে, জাপান সরকার এখন বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিকে তাদের সিস্টেম আপগ্রেড করতে উৎসাহিত করছে। Nomura Research Institute-এর মতো সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা জাপানের বিভিন্ন কোম্পানিকে নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ করতে সহায়তা করছে।
জাপানের এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আমাদের দেশেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ডিজিটাল রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে জাপানের এই সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে, বাংলাদেশ ডিজিটাল ভবিষ্যতের দিকে আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন