চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম ‘জ’ (Jaws)। এই সিনেমাটি শুধু একটি ভয়ঙ্কর থ্রিলার ছিল না, বরং এটি ছিল এক বিশাল বাণিজ্যিক সাফল্য, যা চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারাকেই বদলে দিয়েছিল।
এই সিনেমার পেছনের গল্পটিও কম আকর্ষণীয় নয়, বিশেষ করে এর প্রধান কারিগরদের একজন, জো অ্যালভেসের (Joe Alves) অভিজ্ঞতা।
আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, যখন পিটার বেঞ্চলির (Peter Benchley) লেখা ‘জ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়, তখন এই গল্পটিকে বড় পর্দায় রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।
সেই সময়ে, চিত্র পরিচালক জো অ্যালভেসের কাছে একটি বিশেষ প্রস্তাব আসে – একটি বিশাল, ভয়ঙ্কর হাঙরের মডেল তৈরি করতে হবে।
অ্যালভেসের ভাষায়, শুরুতে সবাই এই সিনেমাটি নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিল না। এমনকি, যারা সিনেমার কারিগর ছিলেন, তারাও জানতেন না কিভাবে এত বড় একটি অ্যানিমেট্রনিক হাঙর তৈরি করা সম্ভব।
কারণ, এর আগে এমন বিশাল আকারের কোন প্রাণী সিনেমায় ব্যবহার করা হয়নি। “শুরুতে, এটিকে একটি ‘ছোট হাঙরের সিনেমা’ হিসেবেই দেখা হতো,” অ্যালভেস জানান।
তবে পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ (Steven Spielberg) ছিলেন ভিন্ন মতের। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই সিনেমা ‘দ্য হিনডেনবার্গ’-এর চেয়েও বড় হতে পারে।
বাস্তবেও তাই হয়েছিল।
‘জ’ শুধু বক্স অফিসে বিশাল সাফল্য লাভ করেনি, এটি দর্শকদের মনেও গভীর দাগ কেটেছিল।
সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্যের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমাটি আয় করেছিল প্রায় ২৭ কোটি ৩৬ লক্ষ ডলার, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এসেছিল ২১ কোটি ৭ লক্ষ ডলার।
অন্যদিকে, ‘দ্য হিনডেনবার্গ’ আয় করতে পেরেছিল মাত্র ২ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার।
অ্যালভেস প্রথমে হাঙরের ছবি আঁকার কাজ শুরু করেন।
এরপর, অসংখ্য গ্রেট হোয়াইট হাঙরের ভিডিও দেখে তিনি এর ডিজাইন তৈরি করেন।
তাঁর ডিজাইন দেখে স্টুডিওর কর্তারা স্পিলবার্গকে পরিচালক হিসেবে নির্বাচন করেন।
এরপর আসল চ্যালেঞ্জ শুরু হয় – কিভাবে এই হাঙর তৈরি করা যায়?
বিশেষ প্রভাব সৃষ্টিকারী দল প্রথমে রাজি ছিল না, কারণ তাদের হাতে ‘দ্য হিনডেনবার্গ’-এর মতো বড় একটি প্রজেক্ট ছিল।
কিন্তু স্পিলবার্গের আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশছোঁয়া।
অ্যালভেস এরপর একজন মেরিন বায়োলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী প্রায় ২৫ ফুট লম্বা একটি হাঙর তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।
এই কাজটি সহজ ছিল না।
কারণ, এর আগে এত বড় আকারের কোন অ্যানিমেট্রনিক প্রাণী তৈরি হয়নি।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অ্যালভেসের সঙ্গে যোগ দেন বব ম্যাটি (Bob Mattey)।
ম্যাটি এর আগে ‘২০,০০০ লীগস আন্ডার দ্য সি’ সিনেমায় বিশাল স্কুইড তৈরি করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
এই সিনেমার জন্য অ্যালভেসকে তিনটি হাঙর তৈরি করতে হয়েছিল।
একটি যাচ্ছিল ডান থেকে বামে, আরেকটি বাম থেকে ডানে, আর অন্যটিকে ক্রেনের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ঘোরানো যেত।
সিনেমার শুটিংয়ের সময় অনেক সমস্যা দেখা দেয়।
বিশেষ করে, হাঙরের শরীরে পানি গেলে এর ইলেকট্রনিক সার্কিট কাজ করা বন্ধ করে দিত।
এছাড়াও, ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে অভিনেতা ও কলাকুশলীদেরও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
শুটিংয়ের সময় একবার হাঙরের দাঁত খুলে আসছিল।
অ্যালভেস সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে সেটি ঠিক করেন।
“আমরা তখন শুটিং বন্ধ করিনি,” তিনি জানান।
সিনেমা মুক্তির আগে টেক্সাসে এর একটি বিশেষ প্রদর্শনী হয়।
সেখানে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়।
সিনেমাটি মুক্তির পরে, এটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, সীমিত প্রেক্ষাগৃহ থেকে এটিকে অনেক বেশি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
‘জ’ শুধু একটি সিনেমা ছিল না, এটি ছিল সেই সময়ের মানুষের কল্পনার জগৎকে নাড়িয়ে দেওয়া এক অসাধারণ সৃষ্টি।
এই সিনেমার সাফল্যের পেছনে ছিল জো অ্যালভেসের মতো প্রতিভাবানদের অক্লান্ত পরিশ্রম, যা চলচ্চিত্র নির্মাণকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে, ‘ব্রুস’ নামে পরিচিত সেই হাঙরের একটি মডেল লস অ্যাঞ্জেলেসের একাডেমি মিউজিয়াম অফ মোশন পিকচার্সে (Academy Museum of Motion Pictures) সংরক্ষিত আছে।
তথ্য সূত্র: পিপল