জেফ ব্রিজেস: অভিনয়ের বাইরে সঙ্গীতের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
ক্যালিফোর্নিয়ার এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে, ৭৪ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি অভিনেতা তাঁর গ্যারেজে বসে ছিলেন।
চারপাশে তাঁর প্রিয় চশমাগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বব ডিলান থেকে মৌমাছির জীবনযাত্রা, ‘ক্রেজি হার্ট’, ‘কাটার্স ওয়ে’ এবং ‘দ্য বিগ লেবোভস্কি’র মতো সিনেমা— বহু বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।
কথার মাঝে মাঝে তাঁর সহকারী এসে অভিনেতাকে একজোড়া করে চশমা ধরিয়ে দিচ্ছিলেন, যেগুলো হয়তো তাঁর পরা চশমার মতোই ছিল।
নরম বাদামী কার্ডিগান পরিহিত ব্রিজেস প্রত্যেকটি চশমা খুঁটিয়ে দেখছিলেন, তারপর সেগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন।
“কোথায় ছিলাম আমরা?” তিনি জানতে চাইলেন।
আসলে, ব্রিজেসের গ্যারেজটি তাঁর গানের স্টুডিও এবং সিরামিক কর্মশালার মতো। সেখানে তাঁর নাতির জন্য ড্রাম সেট রাখা আছে, আর দেয়ালে টাঙানো রয়েছে ক্যাপ্টেন বিফহার্টের একটি ছবি।
সম্প্রতি, ডিসেম্বরে তাঁর জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘দ্য ওল্ড ম্যান’-এর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি এখন অনেকটা সময় এই গ্যারেজেই কাটাচ্ছেন।
তিনি জানালেন, “এখন আমার হাতে কিছু সময় আছে, তাই অন্য কিছু করার সুযোগ পাচ্ছি, যা আমাকে আনন্দ দেয়।
প্রচুর গান করছি, কিছু শিল্পকর্মের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছি।”
জীবনে ভালো কিছু খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে জেফ ব্রিজেসের জুড়ি নেই।
লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুনে তাঁর মালিবুর বাড়িটি পুড়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করার পর তিনি শান্তভাবে বলেছিলেন, “আমরা তো অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প, বন্যায় পাঁচটি বাড়ি হারিয়েছি।
এরপর হয়তো পঙ্গপালের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”
২০২০ সালে নন-হজকিন লিম্ফোমা ধরা পড়ার পর তাঁর চিকিৎসা হয়।
সেই সময়টাকে তিনি উল্লেখ করেন, “কিছু গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা” হিসেবে।
এরপর তিনি আরো বেশি গান প্রকাশ করতে শুরু করেন।
তাঁর যুক্তি ছিল, “যদি কিছু শেয়ার করার থাকে, তবে এটাই সময়, বন্ধু!”
আপাতদৃষ্টিতে এত কিছুর পরেও তাঁকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছিল।
আমি যখন তাঁকে এই কথা বললাম, তখন তিনি মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “অবশ্যই। আমি খুশি।”
আজ আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল ‘স্লো ম্যাজিক’।
এটি ব্রিজেসের পুরনো কিছু গানের সংগ্রহ, যা প্রায় ৫০ বছর ধরে হারিয়ে গিয়েছিল।
রেকর্ড স্টোর ডে উপলক্ষে গানগুলো আবার প্রকাশিত হতে চলেছে।
এই গানগুলো প্রকাশের পেছনের গল্পটা তাঁর কাছে খুবই রহস্যময় ও সুন্দর।
তিনি বলেন, “আমি কি আপনাদের একটু ইতিহাস বলতে পারি?”
এরপর তিনি শোনানো শুরু করলেন এক দারুণ গল্প।
এই গল্পে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী কিফাস সিয়ানসিয়া ও টি বোন বার্নেট, সুপার বোলের জন্য একটি ‘স্কয়ারস্পেস’ বিজ্ঞাপন, ১৯৭৫ সালের কমেডি সিনেমা ‘হার্টস অফ দ্য ওয়েস্ট’, নিউ এজ মিউজিক চার্ট এবং ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে তাঁর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে একটি ক্যাসেট টেপে ধারণ করা কিছু গান।
ব্রিজেসের জীবনের অনেক কিছুই যেন এমন— আকস্মিক সংযোগ এবং ভাগ্যের ছোঁয়া।
তাঁর জন্ম হয় এক বিখ্যাত হলিউড পরিবারে।
মা ডরোথি এবং বাবা লয়েড দুজনেই ছিলেন অভিনেতা।
তাঁর বড় ভাই বিউও অভিনয় করতেন।
ছোটবেলায় জেফ ছবি আঁকা ও সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন।
বাবার উৎসাহে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন এবং বিভিন্ন সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন।
পরিবারের সবাই গান ভালোবাসতেন।
তাঁরা প্রায়ই পিয়ানো বাজিয়ে একসঙ্গে গান করতেন।
তাঁর প্রথম দিকের একটি স্মৃতি হলো, ব্রডওয়ের সুরকার মেরেডিথ উইলসন তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন এবং তাঁর বাবাকে ‘দ্য মিউজিক ম্যান’ নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৬০-এর দশকে তিনি যখন কিশোর, তখন সঙ্গীতের জগতে বড় পরিবর্তন আসে।
চার্লস বেরি এবং এভারলি ব্রাদার্সের পুরনো রক অ্যান্ড রোল গানের বদলে জায়গা করে নেয় বিটলস, বব ডিলান ও রোলিং স্টোনের মতো ব্যান্ড।
ব্রিজেসের হাইস্কুলের বন্ধু-বান্ধবরা ছিল মূলত চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে জড়িত পরিবারের সন্তান।
বন্ধুদের সঙ্গে তিনি কিছুটা ‘আর্টি’ গোছের জীবন যাপন করতেন।
বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর দিনের শুরু হতো একটি বুইক গাড়িতে বসে রেডিও শোনার মাধ্যমে।
প্রতি বুধবার রাতে, তাঁর বন্ধু স্টিভ বাইমের বাড়িতে তাঁরা একটি গানের আসর বসাতেন।
ব্রিজেস বলেন, “সেখানে গান করার কোনো নিয়ম ছিল না।
গান তৈরি করা চলত, তবে রেডিওতে বাজানোর মতো গান নয়।
এটা ছিল একটা বড় গানের আসর।”
হাইস্কুল জীবন শেষ হওয়ার পরও তাঁদের ‘বুধবার রাতের গানের আসর’ চলতেই থাকে।
১৯৭৭ সালের দিকে ব্রিজেস অভিনয় করার পাশাপাশি কিছু গান লিখেছিলেন।
তিনি তাঁর বন্ধুদের সেখানে ডেকে গানগুলো রেকর্ড করেন।
সেই রেকর্ডের ফলস্বরূপ এই অ্যালবামটি তৈরি হয়।
বাবার পরামর্শ সত্ত্বেও, সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সবসময় ছিল।
১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি দুটি গান কুইন্সি জোন্সের কাছে বিক্রি করেন।
এর মধ্যে ‘লস্ট ইন স্পেস’ গানটি ‘জন অ্যান্ড মেরি’ (Dustin Hoffman এবং Mia Farrow অভিনীত) সিনেমার সাউন্ডট্র্যাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
অভিনয়জীবনেও তিনি ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত।
তিনি বলেন, “তখন আমি ১০টা সিনেমায় অভিনয় করেছি, ‘দ্য লাস্ট পিকচার শো’ (১৯৭১)-এর জন্য সেরা পার্শ্ব-অভিনেতার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি, কিন্তু তখনও…”
কথা শেষ না করে তিনি তাঁর সহকারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওহ, ধন্যবাদ প্রিয়, আমি এটা পছন্দ করি।”
এরপর চশমাগুলো ভালোভাবে দেখে বললেন, “না, এটা আমার চশমা নয়!”
১৯৭৩ সালে ‘দ্য লাস্ট আমেরিকান হিরো’ সিনেমাটি করার পর তাঁর মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসে।
তিনি বলেন, “সিনেমাটি করতে আমার খুব ভালো লেগেছিল, তবে সাধারণত একটা সিনেমা করার পর আপনার ‘অভিনয় করার ক্ষমতা’ কমে যায়।
আপনি আর অভিনয় করতে চান না, বরং নিজের মতো থাকতে চান।”
সিনেমার কাজ শেষ হওয়ার কিছু পরেই তাঁর এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালক জন ফ্রাঙ্কেনহাইমারের সঙ্গে দেখা হয়।
তিনি ইউজিন ও’নিলের ‘দ্য আইসম্যান কমেথ’ অবলম্বনে একটি সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন।
ছবিটিতে ফ্রেডেরিক মার্চ, রবার্ট রায়ান এবং লি মারভিনের মতো অভিনেতারা অভিনয় করছিলেন।
প্রথমে ব্রিজেস এই কাজটি করতে দ্বিধা বোধ করেন।
তিনি তাঁর এজেন্টকে কাজটি ফিরিয়ে দিতে বলেন।
এর পাঁচ মিনিট পরেই, ‘দ্য লাস্ট আমেরিকান হিরো’ সিনেমার পরিচালক ল্যামন্ট জনসন ফোন করে তাঁকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন।
এরপর তিনি রাজি হয়ে যান এবং কাজটি করেন।
এরপর তিনি অভিনয়ের দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দেন।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, আমার মধ্যে অনেক প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে।
কোনো সিনেমায় কাজ করার আগে আমি দ্বিধা বোধ করি।
কিন্তু সেই দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে।
আমি ভয় পাই না।”
সম্প্রতি তিনি ঠান্ডা লাগা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
তিনি বলেন, “আমি এখন ঠান্ডা পানিতে ডুব দেওয়ার চেষ্টা করছি এবং ঠান্ডার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কিছুটা বদলেছে।
সাধারণত আমরা ঠান্ডাকে শত্রু মনে করি, কিন্তু এটা আসলে একটা অনুভূতি।
জীবনের সব আবেগ—এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।”
ব্রিজেস সবসময় এমন ছিলেন।
তিনি বলেন, “ছোটবেলার তুলনায় আমি খুব বেশি পরিবর্তন হইনি।
আমার ভেতরের মানুষটা একই আছে।”
নিজেকে কীভাবে বর্ণনা করবেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কিছুক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “ভীতু এবং খেলাপ্রিয়।”
সংগীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন, অভিনয় থেকে এটা কতটা আলাদা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা আমার সত্তার একটা দিক।
আমরা সবসময় জানি না, আমরা আসলে কে।
অভিনয়, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, সিরামিক—এসবের মূল কাজ হলো নিজেকে সরিয়ে রাখা এবং ভেতরের জিনিসটিকে প্রকাশ করতে দেওয়া।
মাঝে মাঝে এটা ভীতিকর হতে পারে।
কিন্তু কখনো কখনো এটা আপনাআপনি হয়ে যায়, আর যখন এটা হয়, তখন দারুণ লাগে!
যখন অন্য শিল্পীদের সঙ্গে মিলে কাজটি করেন, তখন এটা সত্যিই জাদুকরী হয়ে ওঠে।”
গান সবসময়ই তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিককে একসঙ্গে বেঁধেছে এবং অন্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে।
তিনি বলেন, “সিনেমা তৈরি করা হোক বা গান, আপনি তখন সুর মেলাচ্ছেন।
আপনি বলছেন: আসুন, আমাদের শক্তিগুলো একত্রিত করি এবং দেখি আমরা কী তৈরি করতে পারি।
সেটাকে সুন্দর ও বাস্তব করে তুলি।”
অভিনয়ের সময় তিনি তাঁর চরিত্রের জন্য একটি গানের তালিকা তৈরি করেন।
যেমন ‘দ্য বিগ লেবোভস্কি’ সিনেমায় ‘দ্য ডুড’ চরিত্রের জন্য তিনি ‘ক্রিডেন্স’-এর গান ব্যবহার করেছিলেন।
২০০৩ সালে, ব্রিজেস ‘মাস্কড অ্যান্ড অ্যানোনিমাস’ ছবিতে বব ডিলানের সঙ্গে অভিনয় করেন।
একদিন পরিচালক ল্যারি চার্লস তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে কিছু করার পরামর্শ দেন।
ব্রিজেস কিছুটা দ্বিধা নিয়ে রাজি হন।
তিনি বলেন, “তাঁর সঙ্গে কাজ করাটা দারুণ ছিল।
তিনি একজন অসাধারণ অভিনেতা।
তাঁর উপস্থিতি অসাধারণ ছিল।”
কিছুদিন পর, ব্রিজেস তাঁর ট্রেলারে বসে গিটার বাজাচ্ছিলেন, তখন ডিলান এসে তাঁর দরজায় দাঁড়ালেন।
ডিলান জানতে চাইলেন, “আসো, আমরা একসঙ্গে গান করি?”
বর্তমানে ব্রিজেস তাঁর গানের ভাণ্ডার নিয়ে কাজ করছেন।
তিনি এখনো গান লিখছেন।
তাঁর গানের খাতা ও ‘গ্যারেজব্যান্ড’ ফাইলে গানগুলো জমা আছে।
জেফ ব্রিজেস সবসময়ই শিল্পী এবং শিল্পীসত্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং কাজ করার আগ্রহ আজও একইভাবে বিদ্যমান।