ইতালির বাসিলিকাটায়: এক পরিবারে ভোজের আমন্ত্রণ!

ইতালির পাহাড়ি জনপদে এক স্বাদের উৎসব: বাস্তিলিকা অঞ্চলের পারিবারিক ভোজ।

ইতালির বাস্তিলিকা অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রাম, কাস্তেলগ্রান্ডে। দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড় আর সবুজের মাঝে লুকিয়ে থাকা এই গ্রামে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় এক বিশেষ উৎসব – ‘বোরঘি ই স্যাপোরি’। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসে, তাদের শিকড়ের টানে, ভালোবাসার টানে।

ভেনেজুয়েলা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো জায়গা থেকেও এই উৎসবে যোগ দিতে আসে অনেকে।

কাস্তেলগ্রান্ডে গ্রামটি যেন ইতালির খাদ্য সংস্কৃতির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এখানকার মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য – সবকিছুই যেন খাবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মারিয়া কপ্পোলা কোলুচ্চি নামের সত্তরের কোঠায় পা দেওয়া এক বৃদ্ধা, এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য তৈরি করেন নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত, তাঁর রান্নার ব্যস্ততা চলতেই থাকে।

মারিয়ার হাতের জাদু যেন প্রতিটি খাবারে লেগে থাকে। সেপ্পোন্দাপোরতে (ssëppondapòrtë) – স্থানীয় ভাষায় ‘দরজার কব্জা পিন’-এর মতো দেখতে পাস্তা থেকে শুরু করে টাক্কেনুএড্ডে (takkënuèddë) – নানান ধরনের পাস্তা তৈরি করেন তিনি।

মারিয়ার মেয়ে মিরিয়াম জানান, “আমরা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই আলু তুলেছিলাম।” এরপর শুরু হয় রান্নার আসল প্রস্তুতি।

ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবে, মারিয়ার রান্নাঘরে যোগ দেন তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। মিলান থেকে আসা মিরিয়াম, কানাডা থেকে আসা অ্যাঞ্জেলা ফেদেরিচি এবং ইজি কপ্পোলা, আরো অনেকে মিলে এই উৎসবে যোগ দেন।

তাঁরা সবাই মিলে পুরোনো দিনের গল্প করেন, আর রান্নার ফাঁকে চলে হাসি-ঠাট্টা। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় যেন উৎসবের আমেজ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

রান্নার সময় স্থানীয় উপকরণগুলির ব্যবহার বিশেষভাবে চোখে পড়ে। বাড়ির পেছনের বাগান থেকে তোলা তাজা টমেটো, পেঁয়াজ, এবং সুগন্ধি তুলসী পাতা রান্নায় যোগ করা হয়।

আলুর সাথে শুকনো লঙ্কা দিয়ে ভাজা হয়, যা খাবারের স্বাদ আরও বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও, এখানকার স্থানীয় বাদাম ব্যবহার করে বিশেষ সস তৈরি করা হয়, যা উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই উৎসব শুধু খাবারের নয়, বরং এটি একটি সংস্কৃতির উদযাপন। এখানকার মানুষজন তাঁদের অতীতের স্মৃতিগুলো একসাথে উপভোগ করেন।

অ্যাঞ্জেলা ফেদেরিচি জানান, “কানাডার মন্ট্রিয়লে বসবাসকারী কাস্তেলগ্রান্ডের মানুষজন তাঁদের শিকড়ের সাথে সংযোগ রাখতে এই উৎসবের আয়োজন করে।”

উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। আলু এবং স্থানীয় সসেজ দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ নাস্তার পদ পরিবেশন করা হয়, যা এখানকার মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। এছাড়া, নানান ধরনের পাস্তা, মাংসের পদ, এবং মিষ্টি তো আছেই।

আলবের্তো মুরো নামের একজন স্থানীয় ব্যক্তি, যিনি এই অঞ্চলের সংস্কৃতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তিনি জানান, “আমরা এখানে জাফরান চাষের চেষ্টা করছি, যা এই অঞ্চলের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।”

কাস্তেলগ্রান্ডে গ্রামের এই উৎসব যেন এক টুকরো ইতালি, যেখানে খাদ্য, পরিবার এবং সংস্কৃতির এক অপূর্ব মিলন ঘটে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে, এই উৎসব চলে কয়েক দিন ধরে।

রাতের আকাশে তারার মেলা বসে, আর সেই আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে উৎসবের আনন্দ।

সবশেষে, মারিয়ার হাতের তৈরি স্প্যাগেত্তি দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি হয়, যা যেন সূর্যের আলোয় ঝলমলে এক সুন্দর দিনের প্রতিচ্ছবি।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *