জোসেফিন বেকার: মঞ্চের আলো থেকে গুপ্তচর, ফরাসি প্রতিরোধ যোদ্ধা ও মানবাধিকারের লড়াইয়ের অগ্রদূত।
বিংশ শতাব্দীর এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম জোসেফিন বেকার। একদিকে যখন তিনি প্যারিসের মঞ্চ কাঁপিয়ে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছেন, ঠিক তখনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে তিনি জড়িয়ে পড়েন গুপ্তচরবৃত্তির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ শেষে তিনি যোগ দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা জোসেফিন বেকারের জীবনের এই অজানা দিকগুলো উন্মোচন করেছে, যা অনেকের কাছেই হয়তো অজানা।
জোসেফিন বেকার ১৯০৬ সালে আমেরিকার সেন্ট লুইসে জন্ম গ্রহণ করেন। দারিদ্র্য ও বর্ণবৈষম্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই তরুণী ১৯২০-এর দশকে পাড়ি জমান প্যারিসে। সেখানে তিনি ‘লা রিভ্যু নেগ্র’ নামক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন।
তাঁর আকর্ষণীয় নৃত্যশৈলী এবং মঞ্চ পরিবেশনা খুব দ্রুত দর্শকদের মন জয় করে নেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ‘ব্ল্যাক ভেনাস’ নামে পরিচিতি পান এবং ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় বিনোদন তারকায় পরিণত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হলো, জোসেফিন বেকার তখন ইউরোপের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা। ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে জার্মান নাৎসিদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগায়। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি মরক্কো, লিসবন, মাদ্রিদ, সেভিল ও বার্সেলোনার মতো বিভিন্ন শহরে গিয়ে কনসার্ট করতেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।
অভিনয়ের আড়ালে তিনি মিত্রশক্তির জন্য প্রয়োজনীয় গোপন তথ্য সংগ্রহ করতেন, যা যুদ্ধ জয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর খ্যাতি ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে তথ্য সংগ্রহ করা তাঁর জন্য সহজ হয়েছিল। শোনা যায়, তিনি নাকি তাঁর অন্তর্বাসে গুরুত্বপূর্ণ সব নোট লুকিয়ে রাখতেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জোসেফিন বেকার তাঁর দেশের মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে তিনি সেখানকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সঙ্গে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে এক বিশাল মিছিলে অংশ নেন এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন জানান।
জোসেফিন বেকারের জীবন ছিল বহুমাত্রিক। একদিকে তিনি ছিলেন শিল্পী, অন্যদিকে গুপ্তচর এবং সমাজ সংস্কারক। তাঁর এই সংগ্রামী জীবন ফ্রান্স এবং আমেরিকার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, ২০২১ সালে ফ্রান্স সরকার তাঁকে দেশটির সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করে এবং প্যারিসের প্যানথিয়নে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সম্মানের মাধ্যমে ফরাসি জাতি জোসেফিন বেকারের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে, জোসেফিন বেকার শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন সাহসী নারী, যিনি তাঁর খ্যাতিকে ব্যবহার করেছেন যুদ্ধ এবং সমাজের খারাপ দিকগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। তাঁর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়, কিভাবে একজন ব্যক্তি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারেন এবং সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান