চিলির হুয়ান ফার্নান্দেজ দ্বীপপুঞ্জ: প্রকৃতির এক অনন্য আশ্রয়স্থল
দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ চিলি। এই দেশটির উপকূল থেকে বেশ দূরে, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত হুয়ান ফার্নান্দেজ দ্বীপপুঞ্জ।
এই দ্বীপগুলি যেন প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি। এখানকার জীববৈচিত্র্য এতটাই সমৃদ্ধ যে, একে অনেক সময় ইকুয়েডরের গ্যালাপাগোসের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
সম্প্রতি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর একদল অনুসন্ধানী এই দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রকৃতিপ্রেমের এক উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরেছেন।
হুয়ান ফার্নান্দেজ দ্বীপপুঞ্জের প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার বন্যপ্রাণী। বিশেষ করে, এখানকার হুয়ান ফার্নান্দেজ ফার সিল (Juan Fernández fur seals)-এর দল প্রায়ই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
একসময় বিলুপ্তপ্রায় বলে মনে করা হলেও, বর্তমানে এই সিলের সংখ্যা দুই লক্ষেরও বেশি। যা দ্বীপের মানুষের সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি।
এখানকার জলে ডুব দিলে সিলগুলি মানুষের খুব কাছে আসে, যা ডুবুরিদের জন্য এক আনন্দ-উপ experience.
দ্বীপপুঞ্জটি তিনটি প্রধান দ্বীপ নিয়ে গঠিত: রবিনসন ক্রুসো দ্বীপ, আলেকজান্ড্রো সেলকির্ক দ্বীপ এবং সান্তা ক্লারা দ্বীপ। এই দ্বীপগুলিতে এমন অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখা যায় যা পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানকার কমলা পালকের হুয়ান ফার্নান্দেজ ফায়ারক্রাউন হামিংবার্ড এবং কিছু বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি (petrels) এখানকার অন্যতম আকর্ষণ।
দ্বীপগুলির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই মনোমুগ্ধকর যে, রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে মাত্র দু’ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলেই যেন অন্য এক জগৎ-এ প্রবেশ করা যায়।
এখানকার রুক্ষ, পার্বত্য অঞ্চল ট্রেকিং এবং সমুদ্রের ঢেউগুলি সার্ফিং-এর জন্য আদর্শ।
প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যের পেছনে রয়েছে স্থানীয় মানুষের প্রকৃতিপ্রেম এবং দ্বীপের সংরক্ষিত পরিবেশ।
১৯৩৫ সালে এখানকার অধিকাংশ ভূমিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়।
২০১৮ সালে চিলি সরকার এখানে একটি বিশাল সামুদ্রিক পার্ক তৈরি করেছে, যার আয়তন প্রায় ২ লক্ষ ৬২ হাজার বর্গকিলোমিটার।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর অনুসন্ধানী দলের মতে, এখানকার মানুষের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতির সঙ্গে এই সমুদ্র বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
রবিনসন ক্রুসো দ্বীপের চারপাশে ৯৮ শতাংশ মাছ স্থানীয় প্রজাতিভুক্ত। এখানকার জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ যুগ যুগ ধরে মাছ ধরার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলেন।
যেমন, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় তারা মাছ ধরা বন্ধ রাখেন, যাতে মাছের প্রজাতিগুলি তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে।
ডিমওয়ালা স্ত্রী মাছ ধরাও এখানে নিষিদ্ধ।
স্থানীয় জেলেদের প্রকৃতির প্রতি এই ভালোবাসা ও সচেতনতা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
এই দ্বীপপুঞ্জের মৎস্যজীবীরা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তাদের জীবিকার জন্য লবস্টার শিকারের উপর নির্ভরশীল।
এখানকার মৎস্যজীবীরা নিজেরাই কিছু নিয়ম তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে তারা লবস্টার শিকারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করেন।
যেমন, তারা বছরে চার মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখেন এবং ডিমওয়ালা স্ত্রী লবস্টার শিকার করেন না।
এই ধরনের পদক্ষেপ সেখানকার মৎস্যজীবীদের প্রকৃতি সংরক্ষণে গভীর অঙ্গীকারের পরিচয় বহন করে।
এখানে অবস্থিত কোস্টা সানগ্লাস (Costa Sunglasses) নামক একটি সংস্থা, যারা পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে মাছ ধরা এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করে থাকে।
হুয়ান ফার্নান্দেজ দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা বর্তমানে এখানকার সামুদ্রিক এলাকাগুলিকে আরও ভালোভাবে সংরক্ষণের জন্য কাজ করছেন।
ব্লু মেরিন ফাউন্ডেশন (Blue Marine Foundation), আইল্যান্ড কনজারভেশন (Island Conservation) এবং পিউ বার্তারেলি ওশেন লিगेসি (Pew Bertarelli Ocean Legacy)-এর মতো সংস্থাগুলিও এই কাজে তাদের সহযোগিতা করছে।
হুয়ান ফার্নান্দেজ দ্বীপপুঞ্জ যেন বিশ্বকে একটি বার্তা দেয়—প্রকৃতিকে ভালোবাসুন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একে বাঁচিয়ে রাখুন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবী শুধু স্থলভাগ নয়, বরং এটি একটি বিশাল সমুদ্রও বটে। আর তাই, আমাদের সমুদ্রকে রক্ষা করতে হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক