যুদ্ধ সবসময়ই ধ্বংসের বার্তা নিয়ে আসে, কেড়ে নেয় প্রিয়জনদের, আর রেখে যায় গভীর ক্ষত। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর মানুষের ভেতরের অনুভূতির এক জীবন্ত দলিল হলো চিঠি।
সৈন্যদের লেখা এইসব চিঠিগুলো যুদ্ধের ভয়াবহতা আর মানুষের ভেতরের ভালোবাসার এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। সম্প্রতি, এমনই কিছু চিঠি নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি তথ্যচিত্র, যার নাম ‘বিহাইন্ড দ্য লাইনস’।
আমেরিকার যুদ্ধ বিষয়ক চিঠি সংগ্রহ করে এই তথ্যচিত্রটি বানিয়েছেন পরিচালক জন বি. বেনিটজ। এই কাজটি করেছেন অ্যান্ড্রু ক্যারল, যিনি ‘সেন্টার ফর আমেরিকান ওয়ার লেটার্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে ঘুরে সৈন্যদের লেখা চিঠি সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে ১ লক্ষেরও বেশি চিঠি, যা এখন চ্যাপম্যান ইউনিভার্সিটিতে সংরক্ষিত আছে।
এই চিঠিগুলোর শুরুটা হয়েছে আমেরিকান বিপ্লব থেকে, আর এর মধ্যে রয়েছে নানান যুদ্ধ, যেমন – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ইরাক যুদ্ধ।
এইসব চিঠিগুলোতে যুদ্ধের ভয়াবহতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনই যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিতেও মানুষের ভালোবাসার গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। কোনো চিঠিতে একজন সৈন্যের সাধারণ অনুভূতির কথা লেখা, যেখানে সে তার মায়ের কাছে আরও আন্ডারওয়্যার পাঠাতে নিষেধ করছে।
আবার কোনো চিঠিতে জার্মান স্নাইপারের কথা উল্লেখ করে হাসির মাধ্যমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা হয়েছে। এইসব চিঠিতে যুদ্ধের বিভীষিকা আর মানুষের ভেতরের গভীর উপলব্ধির চিত্র পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনার কথা ধরা যাক। পার্ল হারবার আক্রমণের সময় ইউএসএস নিউ অরলিন্স জাহাজের মধ্যে আটকে পড়া উইলিয়াম জাকার নামের এক নাবিকের কথা।
তিনি তাঁর বোনের কাছে পাঠানো চিঠিতে লিখেছিলেন, “প্রিয় বোন, এখন সকাল ৯টা ৫ মিনিট। বোমা পড়ছে আর আমরা এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বোমার শিকার হচ্ছি… আমাদের বিমান বিধ্বংসী কামানগুলো অবিরাম চলছে, আর মাঝে মাঝে বোমা এত কাছে পড়ছে যে জাহাজটি কেঁপে উঠছে।
আমরা ইঞ্জিনের একেবারে নিচে অসহায় অবস্থায় আছি।” সৌভাগ্যবশত, জাকার সেই হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন এবং পরে তিনি নৌবাহিনীতে কাজ করেন।
যুদ্ধের স্মৃতিগুলো সব সময়ই কষ্টের। তেমনই একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো ল্যান্স কর্পোরাল অ্যারন অস্টিনের চিঠি।
ইরাক যুদ্ধের সময়, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি তাঁর বাগদত্তা টিফানির কাছে একটি টেপ রেকর্ড করেন। সেই রেকর্ডিংয়ে অ্যারন তাঁর ভালোবাসার কথা জানান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলেন।
অ্যারন তাঁর পরিবারকে ভালোবাসতেন এবং তাদের সঙ্গে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে চেয়েছিলেন, যা তাঁর কপালে ছিল না।
যুদ্ধ মানুষের সম্পর্কগুলোতেও প্রভাব ফেলে। ১৮৬৩ সালে, আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় ‘জন এন.’ নামের এক সৈন্য প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কাছে একটি চিঠি লেখেন।
তিনি তাঁর স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা উল্লেখ করে তাকে ডিভোর্স দেওয়ার আবেদন করেন।
এই তথ্যচিত্রটি যুদ্ধের স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখার একটি দারুণ প্রয়াস। এটি শুধু যুদ্ধের ইতিহাস নয়, বরং যুদ্ধের সময় মানুষের অনুভূতিগুলোকেও তুলে ধরে।
এইসব চিঠিগুলো যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং মানুষের আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তথ্যসূত্র: পিপল