আধুনিক যুগেও কেন তীর্থযাত্রার দিকে ঝুঁকছে মানুষ?

প্রাচীন তীর্থযাত্রা: যুক্তরাজ্যের নতুন আকর্ষণ। যুগে যুগে মানুষ শান্তির অন্বেষণে বেরিয়েছে, খুঁজেছে আত্মিক প্রশান্তি।

এই অনুসন্ধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তীর্থযাত্রা। যুক্তরাজ্যে (UK) আবারো পুরনো দিনের তীর্থযাত্রার চল ফিরে এসেছে, যা বাংলাদেশের মানুষের কাছেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

যুক্তরাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত হিয়ারফোর্ডশায়ারের ‘গোল্ডেন ভ্যালি পিলগ্রিম ওয়ে’ (Golden Valley Pilgrim Way) তেমনই একটি তীর্থপথ। এটি প্রায় ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা হেঁটে পার হতে সাধারণত চার দিন সময় লাগে।

এই পথটি প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে গেছে, যেখানে সবুজ ভূমি আর ওয়েলসের (Wales) ব্ল্যাক মাউন্টেনের (Black Mountains) রুক্ষতা মিলেমিশে একাকার। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, যা এটিকে তীর্থযাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলে।

হিয়ারফোর্ড ক্যাথেড্রাল (Hereford Cathedral) সহ এখানে বেশ কিছু পুরনো গির্জা রয়েছে, যা তীর্থযাত্রীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।

এই পথ তৈরি করেছেন অ্যাবিডোর ডিনারি (Abbeydore Deanery) -র একজন গ্রামীণ পুরোহিত, সাইমন লকেট (Simon Lockett)। তিনি ইতালিতে একটি রূপান্তরকারী তীর্থযাত্রা করার পর এই ধারণা পান।

সাইমনের মতে, আজকের দিনে যারা তীর্থযাত্রায় যাচ্ছেন, তারা হয়তো সরাসরি ধার্মিক নন, কিন্তু তাদের মধ্যে আত্মিক অনুসন্ধানের আগ্রহ প্রবল। তারা প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে গভীর চিন্তা করতে ভালোবাসেন এবং তাদের এই পথগুলি সেই সুযোগ করে দেয়।

গোল্ডেন ভ্যালি পিলগ্রিম ওয়ে-এর যাত্রা শুরু হয় হিয়ারফোর্ড ক্যাথেড্রাল থেকে। পথের শুরুতে পর্যটকদের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে আসে: হাঁটা, খাওয়া এবং বিশ্রাম—এটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়।

এখানকার স্থানীয় কসাই ও বেকারি থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করা যায়। পথে পুরনো ল্যান্ডমার্কগুলোর (Landmark) সাহায্য নেয়া হয়, যার ফলে পথ খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।

এই পথের একটি বিশেষ দিক হলো স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া। পথের মাঝে ম্যাডলি (Madley) নামে একটি গ্রামে তীর্থযাত্রীরা স্থানীয়দের সঙ্গে মিলিত হন।

ষষ্ঠ শতকে এখানে সেন্ট ডুব্রিসিয়াসের জন্ম হয়েছিল এবং তিনি একটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। সেখানকার একটি ক্যাসেলের (Castle) আতিথেয়তা ও উষ্ণতা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো।

এই পথের মাধ্যমে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।

এরপর পথ চলতে থাকে মোক্কাস পার্কের (Moccas Park) পুরনো ওক গাছের পাশ দিয়ে, যার কিছু গাছের বয়স আটশ বছর। এছাড়া, এখানকার আর্থার’স স্টোন (Arthur’s Stone) নামক একটি পাহাড়ি সমাধিস্থল রয়েছে, যা পাঁচ হাজার বছর ধরে এই উপত্যকার সাক্ষী হয়ে আছে।

পথের শেষে ডরস্টোনের (Dorstone) সেন্ট ফেইথস চার্চে (St Faith’s Church) বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ হয়। এখানকার একটি চার্চে (Church) রাত কাটানো অনেকটা একটি পাঁচতারা হোটেলে (Hotel) থাকার মতো।

যদিও এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা কম, তবুও এই স্থানটি প্রায় ১২৫৬ সাল থেকে টিকে আছে। এখানকার স্থানীয় একটি পাব-এ (Pub) রাতের খাবার খাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে।

গোল্ডেন ভ্যালি পিলগ্রিম ওয়ে-এর প্রতিটি চার্চে তীর্থযাত্রীদের পাসপোর্ট-এ স্ট্যাম্প (Stamp) লাগানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এই রীতি পথটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

স্থানীয় সেন্ট মাইকেল চার্চে (St Michael’s Church) বাইবেলের (Bible) ছবি আঁকা রয়েছে, যা বিশ্রামবার পালনকারীদের সতর্ক করে। ক্রাসওয়ালের (Craswall) সেন্ট মেরী’স চার্চের (St Mary’s Church) দেয়ালে শিশুদের ছবি দেখা যায়, যা একসময় গ্রামের বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

ক্লডকের (Clodock) সেন্ট ক্লডওগ’স চার্চের (St Clydawg’s Church) ভেতরে রয়েছে এক বিরল ধরনের পবিত্র স্থান। এখানকার সবকিছুই যেন ইতিহাসের সাক্ষী।

এই পথটি কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য আর ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করায় না, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি ও মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতেও সহায়তা করে। স্থানীয় পাবগুলোতে (Pub) মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়, যা এই যাত্রাকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।

গোল্ডেন ভ্যালি পিলগ্রিম ওয়ে-এর মতো তীর্থযাত্রাগুলো মানুষকে তাদের শিকড়ের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে সাহায্য করে। এই ধরনের যাত্রা আত্ম-অনুসন্ধান এবং মানসিক শান্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *