আজকালকার দিনে ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুডের প্রতি আমাদের আকর্ষণ যেন বেড়েই চলেছে। বার্গার, পিৎজা থেকে শুরু করে মিষ্টি ও ভাজাভুজি—এগুলো চোখের সামনে দেখলে অনেক সময়ই নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।
কিন্তু কেন এমন হয়? সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ খুঁজে পেয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এই খাবারগুলো আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিতে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, খাওয়ার রুচি না থাকলেও সেগুলি আমাদের খেতে উৎসাহিত করে।
প্রকৃতি বিষয়ক একটি জার্নালে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় জানা গেছে, মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামক অংশে উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবারের স্মৃতি জমা থাকে। ইঁদুরের ওপর করা একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, যখন তাদের হিপোক্যাম্পাসের নির্দিষ্ট কিছু কোষকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়, তখন তারা চিনিযুক্ত খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয় এবং তাদের শরীরে অতিরিক্ত মেদও জমা হয় না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রত্যেক প্রাণীরই বাঁচার জন্য খাবার প্রয়োজন। তাই ক্ষুধা আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এই গবেষণায় ক্ষুধা ছাড়াও স্মৃতি-নির্ভর ক্ষুধার বিষয়টি উঠে এসেছে। অর্থাৎ, খাবারের স্মৃতিও আমাদের খাওয়ার প্রবণতাকে প্রভাবিত করে।
আসলে, খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা বাইরের জগৎ ও ভেতরের অনুভূতির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করি, যা এক ধরনের স্মৃতি তৈরি করে। কোনো খাবার খেলে আমাদের কেমন লাগে, সেই অনুভূতিগুলো মস্তিষ্কে জমা হয়।
পরবর্তীতে, যখন আমরা সেই খাবারের স্বাদ আবার পাই, তখন মস্তিষ্কের পুরানো স্মৃতি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমাদের সেই খাবারটি খেতে ইচ্ছে করে। সহজ ভাষায় বললে, একবার কোনো খাবার খেলে, সেই খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও আমাদের অনুভূতির একটি ডাটাবেস তৈরি হয় মস্তিষ্কে।
এরপর সেই খাবারটি আবার দেখলে বা তার কথা মনে হলে, সেই স্মৃতি আমাদের আবারও সেই খাবারটি খেতে প্ররোচিত করে।
গবেষকরা বলছেন, ফাস্ট ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রায়ই চিনি ও ফ্যাট—উভয়ই একসঙ্গে থাকে। এই খাবারগুলো মস্তিষ্কের একইসঙ্গে দুটি পথকে সক্রিয় করে তোলে, যা আমাদের আরও বেশি আকর্ষণ করে।
আর তাই, একবার এইসব খাবার খেলে, তা সহজে ত্যাগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আমাদের চারপাশে এখন উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবারের ছড়াছড়ি। রাস্তার মোড়ে, শপিং মলে, এমনকি অনলাইনেও এইসব খাবার সহজলভ্য। ফলে, আমাদের স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়।
তাহলে কি এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই? অবশ্যই আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মস্তিষ্ক পরিবর্তনযোগ্য। তাই, খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরি হওয়ার মতো, নতুন কিছু বিষয় শিখে সেই আসক্তি কমানোও সম্ভব।
এক্ষেত্রে থেরাপি এবং কিছু ওষুধ সাহায্য করতে পারে। যেমন, খাদ্য-সম্পর্কিত আচরণ পরিবর্তনের জন্য থেরাপি এবং কিছু ওষুধ, যা মস্তিষ্কের আনন্দ-সংকেতকে কমাতে সাহায্য করে। তবে, মনে রাখতে হবে, ওষুধের মাধ্যমে ক্ষুধা কমানো গেলেও, অতিরিক্ত খাওয়ার মূল কারণটি কিন্তু থেকেই যায়।
তাই, ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের দিকেও নজর দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হলো, কেন আমরা কোনো খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি, তা খুঁজে বের করা। এটা কি সত্যিই ক্ষুধা, নাকি অন্য কোনো আবেগ?
একবার কারণ জানা গেলে, সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। সচেতনতা এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনে রাখতে হবে, খাবারের প্রতি আকর্ষণ একটি স্মৃতি নির্ভর প্রক্রিয়া।
তাই, এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা থাকলে, আমরা আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে পারব এবং খাবারের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক