কাশ্মীর পরিস্থিতি: ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা, সিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি
সাম্প্রতিক কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। উভয় দেশই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, যা বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।
বিশেষ করে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে তারা ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি বাতিল করতে পারে।
জম্মু ও কাশ্মীর, যা উভয় দেশের জন্যই একটি বিতর্কিত অঞ্চল, সেখানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার জেরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
গত ২২শে এপ্রিল, কাশ্মীরের পাহালগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করে।
এর মধ্যে অন্যতম ছিল, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা, যা উভয় দেশের মধ্যে নদীর জল ব্যবহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এছাড়া, সীমান্ত বন্ধ করা, বাণিজ্য স্থগিত করা এবং ভারতে কর্মরত পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সংখ্যা কমানোর মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
জবাবে, পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি) একই ধরনের পদক্ষেপের ঘোষণা করে। এর মধ্যে সীমান্ত ও আকাশপথ বন্ধ করা, বাণিজ্য স্থগিত করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সিমলা চুক্তি সহ ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমস্ত চুক্তি বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়।
সিমলা চুক্তি: দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি
১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের কাছে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর, ১৯৭২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলায় মিলিত হন।
এই বৈঠকের ফলস্বরূপ, সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা কাশ্মীর সহ দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই চুক্তিতে নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি)-কে উভয় পক্ষ কর্তৃক সম্মান জানানোর বিষয়েও উল্লেখ ছিল।
চুক্তি বাতিলের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে তা উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিশেষ করে, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সামরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিমলা চুক্তি বাতিল করা হলে কাশ্মীর সমস্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বেশি গুরুত্ব পেতে পারে। কারণ, এই চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরকে দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছিল।
ফলে, চুক্তি বাতিল হলে, পাকিস্তান পুনরায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) হস্তক্ষেপের দাবি জানাতে পারে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ দীর্ঘদিনের। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই এই অঞ্চলটি নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। উভয় দেশই কাশ্মীরের পুরোটা নিজেদের অংশ বলে দাবি করে।
সিমলা চুক্তির গুরুত্ব
সিমলা চুক্তি উভয় দেশের মধ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশ আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি দেশের মধ্যে যেকোনো ধরনের সংঘাত পুরো অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করতে পারে।
বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক ছিল। তাই, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
উপসংহার
কাশ্মীর পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বর্তমানে একটি সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
উভয় দেশেরই উচিত আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করা, যাতে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা