কাশ্মীরে পর্যটন শিল্পে বিপর্যয়: সন্ত্রাসী হামলা ও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার জেরে চরম ক্ষতি।
শ্রীনগর, ভারত – কাশ্মীরের মনোরম উপত্যকা, যা এক সময় পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য ছিল, এখন যেন এক নীরব জনপদ। গত মাসে হওয়া সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার পর্যটন শিল্পে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। উপত্যকার হোটেল, কাঠের তৈরি হাউসবোটগুলো এখন প্রায় খালি।
বরফে ঢাকা পাহাড়গুলোতেও বিরাজ করছে নীরবতা। শত শত ট্যাক্সি রাস্তার পাশে অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
গত ২২শে এপ্রিল, কাশ্মীরের পাহালগামে পর্যটকদের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ হামলা। এতে বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পর্যটক। এই ঘটনার পর আতঙ্কিত পর্যটকেরা কাশ্মীর ত্যাগ করতে শুরু করেন। এরপর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
উভয় দেশই সীমান্তে পাল্টাপাল্টি হামলা চালায়, যা কাশ্মীরকে তৃতীয় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরের হাউসবোট ব্যবসায়ী ইয়াসিন টুম্যান জানান, “পর্যটকদের আনাগোনা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এখন এক ভয়ঙ্কর নীরবতা বিরাজ করছে।”
আতঙ্কের কারণে হামলার কয়েক দিনের মধ্যেই হাজার হাজার পর্যটক কাশ্মীর ছেড়ে চলে যান। এরপর কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়, যা সেখানকার ব্যবসার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। টেলিভিশনে প্রচারিত ভয়ঙ্কর ছবিগুলোও আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেয়।
ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে, যদিও পাকিস্তান তা অস্বীকার করেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের অগ্রিম বুকিং বাতিল হতে শুরু করে। ১০ই মে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়, কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
ট্যুর অপারেটররা বলছেন, এরপরও নতুন করে তেমন কোনো বুকিং আসেনি।
কাশ্মীর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ বশির আহমেদ জানান, “আগে জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার রুম বুকিং ছিল। এখন প্রায় সবই বাতিল হয়েছে। এর ফলে, হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।”
এই বিপর্যয়ের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। হস্তশিল্প, খাবার দোকান এবং ট্যাক্সি ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এক সময়ের জনপ্রিয় স্থান গুলমার্গ এবং পাহালগামের মতো মনোরম জায়গাগুলো এখন পর্যটকশূন্য।
শ্রীনগরের ডাল লেকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা শিকারার (নৌকা) সারিগুলোও এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। দিনমজুর শ্রমিকদের কাজ নেই বললেই চলে।
এক নৌকার মাঝি ফায়াজ আহমেদ বলেন, “আগে নৌকায় চড়ার জন্য পর্যটকদের দীর্ঘ লাইন দেখা যেত, এখন আর কেউ নেই।”
ট্যাক্সিচালক মোহাম্মদ ইরফান জানান, “আগে পর্যটকদের পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে নিয়ে যেতাম, মুঘল আমলের বাগান দেখাতাম। এখন আমার ট্যাক্সি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে গ্যারেজে পড়ে আছে।”
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাশ্মীরের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল প্রায় ৭ শতাংশ। কাশ্মীর সরকারের শীর্ষস্থানীয় নির্বাচিত কর্মকর্তা ওমর আবদুল্লাহ, পর্যটকদের ওপর হামলার আগে জানিয়েছিলেন, আগামী চার-পাঁচ বছরে তাঁরা পর্যটনের অবদান ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে চান।
১৯৮৯ সালে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগে কাশ্মীর পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান ছিল। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এই সুন্দর অঞ্চলে পর্যটন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
তবে, ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার পর পর্যটন শিল্প ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। যদিও মাঝে মাঝে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা দেখা দেয়, তবুও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার মাধ্যমে সরকার পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার এবং ২০২২ সালে প্রায় ২৬ লাখ ৭০ হাজার পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণ করেছেন। এই সংখ্যা বেড়ে ২০২৪ সালে প্রায় ৩০ লাখে পৌঁছেছিল।
পর্যটকদের আগমন স্থানীয় অনেক মানুষকে এই খাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে, যার ফলস্বরূপ পারিবারিক গেস্ট হাউস, বিলাসবহুল হোটেল এবং পরিবহন সংস্থা গড়ে ওঠে।
পর্যটকদের এই আগমন মোদি সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল, কারণ তারা মনে করত পর্যটকদের আগমন উপত্যকার স্বাভাবিক অবস্থার প্রমাণ। যদিও, গত বছর ওমর আবদুল্লাহ এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।
পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ইয়াসিন টুম্যান বলেন, “গ্রীষ্মকালে বুকিং প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়ায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে।”
হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা শেখ বশির আহমেদ মনে করেন, কাশ্মীরের উন্নয়নের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের সমাধান হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, “পর্যটনের জন্য শান্তি প্রয়োজন। যদি কাশ্মীরের সমস্যার সমাধান না হয়, তবে হয়তো দুই মাস পর আবার একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস