বিখ্যাত ব্রিটিশ শিল্পী কেন কিফের (Ken Kiff) শিল্পকর্মগুলো সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ চিত্রকলার জগতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তাঁর কাজে রঙ ও গড়নের এক চমৎকার মিশ্রণ দেখা যায়, যেখানে বিচিত্র সব কল্পনাবাদী চরিত্র ও দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ক্লেই (Klee) এবং মিরোর (Miró)-এর মতো আধুনিকতাবাদী শিল্পীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কেন কিফ রংকে তাঁর কাজের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বিমূর্ততার সঙ্গে তিনি নিজের ব্যক্তিগত জগৎ থেকে নেওয়া কিছু প্রতীক ব্যবহার করতেন, যেমন পাখি, স্যালামান্ডার, পাহাড়, জল এবং “ছোট্ট মানুষ” – এই চরিত্রটি তাঁর ক্যানভাসে প্রায়ই দেখা যেত।
কেন কিফের কাজে জীবনের আনন্দ ও বেদনা—উভয়ই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে ধরা দিয়েছে। শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন স্বকীয় এবং একই সঙ্গে সবার কাছে আপনজন।
২০০১ সালে ৬৫ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণের পর অনেকেই তাঁকে একজন “শিল্পীর শিল্পী” হিসেবে বিবেচনা করতেন। কারণ, সেই সময়ে প্রভাবশালী শিল্পীগোষ্ঠী ইয়ং ব্রিটিশ আর্টিস্টদের (YBAs) তুলনায় তাঁর কাজ ছিল অনেক বেশি ব্যক্তিগত এবং নিরীক্ষামূলক।
তবে বর্তমানে তাঁর কাজ নতুন করে আগ্রহ তৈরি করেছে। লন্ডনের হ্যালস গ্যালারির পরিচালক এলা-রোজ হ্যারিসন বলেন, “কেন কিফের কাজের বিমূর্ততা ও চিত্রের মিশ্রণ তরুণ প্রজন্মের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। তাঁর বিষয়বস্তুগুলোও নতুনভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তিনি দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে পৌরাণিক বিষয়গুলো নিয়ে এসেছেন, যা মনস্তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”
কেন কিফ ছিলেন এমন দ্বিতীয় শিল্পী, যিনি লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে (National Gallery) তাঁদের সংগ্রহ থেকে শিল্পকর্মের ওপর ভিত্তি করে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এই কাজটি ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক। এর আগে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন শিল্পী পাওলা রেগো (Paula Rego)। কেন কিফের পর এই সুযোগ পান পিটার ব্লেক (Peter Blake)।
যদিও ন্যাশনাল গ্যালারির সঙ্গে কাজ করতে তাঁর কিছু দ্বিধা ছিল। কেন কিফের মেয়ে আনা জানান, “তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তিনি জানতেন, এটা একটা পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ।
তাঁর বেড়ে ওঠা ছিল সাধারণ পরিবারে, তাই এই পরিবেশে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না।”
গ্যালারির সংগ্রহে থাকা পুরনো মাস্টারদের শিল্পকর্ম থেকে অনুপ্রেরণা নিতে গিয়ে তিনি তাদের গভীরতা অনুভব করতে চেষ্টা করতেন।
রুবেস, ভ্যান গগ, রেমব্রান্ট, পিসানেলো বা জিওভানি ডি পাওলোর কাজ তাঁর ভালো লাগত। তিনি পুরনো মাস্টারদের শিল্পকর্মের কাঠামোগত দিকগুলোও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো চিত্রের কাঠের কাঠামো অথবা সোনার প্রলেপ—এগুলো তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করত। একটি রেনেসাঁস-এর ল্যান্ডস্কেপের ঘোলাটে রঙের ছোঁয়াও তাঁর নিজস্ব কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারত।
কিছু ক্ষেত্রে, কেন কিফ মূল চিত্রকর্মের বিষয় ও চরিত্রগুলো গ্রহণ করে নিজের মতো করে সেগুলোকে প্রকাশ করেছেন।
যেমন, জন দ্য ব্যাপটিস্ট, সেইন্ট ইউস্টেস বা সেইন্ট জেরোমের মতো চরিত্রগুলো তাঁর “ছোট্ট মানুষ”-এর মতোই একাকী পথিকের প্রতিচ্ছবি।
আবার, তাঁর কিছু চিত্রকর্ম অতীতের ধারণাগুলোকে যেন নতুনভাবে উপস্থাপন করে। যেমন, বেলিনির আঁকা ‘দ্য অ্যাসাসিনেশন অফ সেন্ট পিটার মার্টায়র’ (The Assassination of Saint Peter Martyr) নামক একটি পুরুষতান্ত্রিক দৃশ্যের অনুপ্রেরণা থেকে তিনি তৈরি করেন ‘ওম্যান ওয়াচিং আ মার্ডার’ (Woman Watching a Murder) ।
যেখানে নীল আকাশের টুকরোর মাধ্যমে তিনি এমন একটি দৃশ্য তৈরি করেছেন, যেখানে একটি বিশাল নারীমূর্তি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একটি দম্পতির ঝগড়া দেখছেন।
কেন কিফ ন্যাশনাল গ্যালারির এই প্রকল্পের বিষয়ে লিখেছিলেন, “একটি চিত্রকর্ম কেবল কিছু নিয়ম মেনে চললেই ভালো হয় না, বরং একটি ‘চিন্তা’ বা ‘অনুভূতি’ যখন প্রকাশিত হয়, তখনই তা সার্থক হয়।”
কেন কিফের কাজগুলো নিয়ে ‘কেন কিফ: দ্য ন্যাশনাল গ্যালারি প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি লন্ডনের হ্যালস গ্যালারিতে আগামী ২৪ মে পর্যন্ত চলবে।
তথ্য সূত্র: The Guardian