কেনিয়ার চার্চে মৃত্যু: গোপন কবর ও ‘ধর্মীয় ভণ্ডামি’, ভয়ঙ্কর রহস্য!

কেনিয়ার চার্চে গোপন কবর এবং ‘কাল্ট’-এর মতো কার্যকলাপের অভিযোগ উঠেছে।

দেশটির পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং চার্চের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, কেনিয়ার মিগোরি কাউন্টির ওমাপো গ্রামে অবস্থিত ‘মেলকিয়ো সেন্ট জোসেফ মিশন্স অফ মেসিয়াহ চার্চ ইন আফ্রিকা’ নামের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলি উঠেছে।

পুলিশ সূত্রে খবর, গত ২১শে এপ্রিল চার্চে অভিযান চালিয়ে দুটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন পুলিশের কনস্টেবল।

এছাড়া, চার্চের ভেতর থেকে আরও বহু সদস্যকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ ছিলেন এবং তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই চার্চটি দীর্ঘদিন ধরে গোপনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

তারা চান, দ্রুত এই চার্চ বন্ধ করে সেখানে কবর দেওয়া মৃতদেহগুলো সনাক্ত করা হোক।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩০ বছর আগে এই চার্চটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা ব্রায়ান জুমা জানান, চার্চের প্রতিষ্ঠাতা নিজেকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে দাবি করতেন এবং অনুসারীরা তাকে পূজা করত।

জুমার ভাষ্যমতে, চার্চের প্রধানের মৃত্যুর পর অনুসারীরা তাকে কবর না দিয়ে তিন দিন ধরে প্রার্থনা করেছিলেন, এই বিশ্বাসে যে তিনি পুনরায় জীবিত হবেন।

আরেক স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৩ বছর বয়সী পাওলিন আউমা জানান, চার্চটি মূলত বাইরের লোকজনকে আকৃষ্ট করত এবং তাদের সদস্য করত।

একসময় তার বোনও এখানে নিয়মিত যেতেন, কিন্তু সেখানে অস্বাভাবিক কিছু কার্যকলাপ হতে দেখে তিনি দ্রুত ফিরে আসেন।

পাওলিন আরও জানান, চার্চের প্রধান নিজেকে ঈশ্বর দাবি করতেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চার্চের সদস্যরা কেনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে আসতেন এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল।

তারা সাধারণত চার্চের বাইরে যেতেন না এবং স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না।

মানবাধিকার কর্মী কারেন কিয়ারির মতে, এই চার্চের কেনিয়ার নিয়ানজা অঞ্চলে আরও শাখা রয়েছে এবং সদস্যদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো হতো।

স্থানীয়দের মতে, চার্চের সদস্যরা বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও, তাদের সন্তানরা স্কুলে যেত না এবং অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসা করারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

পুলিশি অভিযানের সময় উদ্ধার হওয়া অনেক সদস্যকে দুর্বল এবং অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়।

তাদের হাসপাতালে নেওয়ার পরও তারা চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন এবং স্থানীয় ভাষায় প্রার্থনা করতে শুরু করেন।

এদিকে, হোমা বে কাউন্টির বাসিন্দা লিনেট আচিং তার ৭১ বছর বয়সী মায়ের সন্ধান করছেন, যিনি ১১ বছর আগে এই চার্চে যোগ দিতে গিয়েছিলেন।

আচিং জানান, তার মা প্রথমে পিঠের ব্যথার চিকিৎসার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন।

কিন্তু এরপর তিনি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

আচিং বহুবার মাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুলিশের অভিযানে আচিং জানতে পারেন, তার মাকেও উদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু তিনি পরিবারের সঙ্গে থাকতে রাজি নন।

অন্যদিকে, ড্যান আয়ো ওবুরা নামের এক পুলিশ কনস্টেবলের মৃত্যু হয়েছে এই চার্চে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭শে মার্চ তার মৃত্যু হয়।

ওবুরার পরিবারের সদস্যরা জানান, তার স্ত্রীও এই চার্চের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

ওবুরার কাকা ডিকসন ওতিয়েনো জানান, অসুস্থতাজনিত কারণে ওবুরা কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে কিসুমু কাউন্টিতে ফিরে আসেন।

এর কিছুদিন পরেই তিনি নিখোঁজ হন।

পরে তারা জানতে পারেন, তিনি মিগোরির একটি চার্চে আছেন।

ওতিয়েনো আরও জানান, “আমরা চার্চের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ওবুরার বিষয়ে জানতে চাই, কিন্তু তারা প্রথমে অস্বীকার করে।

পরে তারা জানায়, ওবুরার মৃত্যু হয়েছে এবং তাকে কবর দেওয়া হয়েছে।”

এই ঘটনার পর ওবুরার পরিবার পুলিশের সাহায্য চায় এবং তার মৃতদেহ সনাক্ত করার জন্য ওমাপোতে যায়।

মানবাধিকার কর্মী কিয়ারি জানান, তিনি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং চার্চের ভেতরে সংঘটিত কিছু উদ্বেজনক ঘটনার কথা জানতে পেরেছেন।

কিয়ারি আরও জানান, “চার্চে কোনো প্রকার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি ছিল না এবং বিবাহিত দম্পতিদেরও আলাদা থাকতে বাধ্য করা হতো।”

স্থানীয়দের ধারণা, চার্চের ভেতরে আরও অনেক মৃতদেহ থাকতে পারে, যে কারণে ওবুরার দেহাবশেষ উদ্ধারে দেরি হচ্ছে।

এই ঘটনার সঙ্গে ২০১৮ সালে কেনিয়ার শাকাহোলা জঙ্গলে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

সেখানেও একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যরা অনাহারে মারা গিয়েছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্মীয় নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করা এবং তাদের কথাকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

এই ধরনের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটানো জরুরি।

বর্তমানে কেনিয়ার পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত করছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *