আফ্রিকার কেনিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে, প্রকৃতির এক মনোমুগ্ধকর লীলাভূমি – যেখানে সাফারির হাত ধরে সহাবস্থানে আসে ঐতিহ্যবাহী মাসাই সংস্কৃতি। মাসাই মারা ন্যাশনাল রিজার্ভ এবং শম্পোলের মতো অঞ্চলে, বন্যজীবন এবং স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা যেন একে অপরের পরিপূরক।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদন সেই চিত্রটিই তুলে ধরেছে, যেখানে পর্যটন এবং সংরক্ষণের এক চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।
মাসাই সম্প্রদায়ের মানুষজন যুগ যুগ ধরে কেনিয়ার এই অঞ্চলে পশুপালন করে আসছেন। তাদের জীবনযাত্রা প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি, যেখানে বুনো প্রাণীদের অবাধ বিচরণ, তাদের সঙ্গেই মাসাইদের বসবাস। এই অঞ্চলের প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে সিংহ।
পর্যটকদের আনাগোনা এখানে একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করেন স্থানীয় মাসাই যুবক-যুবতীরা। তারা কেবল গাইড নন, বন্যপ্রাণী এবং প্রকৃতির গভীর পর্যবেক্ষকও বটে।
বনের গভীরে তাদের অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। পর্যটকদের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং তাদের সংরক্ষণে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কেনিয়ার এই অঞ্চলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কমিউনিটি-ভিত্তিক একটি মডেল বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। স্থানীয় মাসাই সম্প্রদায়ের জমি লজ এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ভাড়া দেওয়া হয়, যার ফলে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হন।
এর ফলে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে তাদের একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
মাসাই মারাতে, শিকারের উদ্দেশ্যে বন্যপ্রাণী হত্যা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় কমিউনিটি এখন বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করার জন্য আরও বেশি সচেতন।
কেনিয়া ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের (Kenya Wildlife Trust) মতো সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
শম্পোলে, একটি ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এখানকার শুষ্ক অঞ্চলে, ইওসো এনগিরো নদী জীবন নিয়ে আসে।
নদীর তীরে অবস্থিত শম্পোল ওয়াইল্ডেরনেস-এর মতো ছোট ছোট ক্যাম্পগুলো স্থানীয় মাসাই সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে। এখানে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়।
স্থানীয় মাসাই নেতা জন কামাঙ্গার (John Kamanga) নেতৃত্বে, এই অঞ্চলে ভূমি মালিকদের একটি সংগঠন (SORALO) গড়ে উঠেছে, যা বন্যপ্রাণী এবং মানুষের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে কাজ করে।
এই সংগঠনের মাধ্যমে, মাসাই সম্প্রদায়ের সদস্যরা রেঞ্জার হিসেবে কাজ করেন, যারা বন্যপ্রাণী এবং গবাদি পশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
ইলায়েতোক (Ilaaretok) নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে, স্থানীয় মাসাইদের সাহায্যকারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাদের প্রধান কাজ হল গবাদি পশুদের দেখাশোনা করা এবং বন্যপ্রাণী ও মানুষের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত কমানো।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে, স্থানীয় মানুষেরা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হচ্ছেন।
পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য এখানে বিশেষ ধরনের ফটোগ্রাফি হাইড তৈরি করা হয়েছে, যা বন্যপ্রাণীদের ছবি তোলার এক দারুণ সুযোগ করে দেয়।
রাতের বেলা, এখানকার হাইডগুলোতে বসে বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ দেখা যায়, যা ফটোগ্রাফারদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, কেনিয়ার মাসাই সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি এবং সাফারির এই সহাবস্থান একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ, সচেতনতা এবং বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং পর্যটনের মধ্যে একটি সুন্দর সমন্বয় তৈরি হয়েছে, যা একইসঙ্গে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক