জন এফ কেনেডির ‘ক্যামেলট’-এর স্বপ্ন আর বর্তমান আমেরিকার বাস্তবতা।
ষাটের দশকে, যখন জন এফ কেনেডি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন বিশ্বে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছিল। ‘নিউ ফ্রন্টিয়ার’ বা নতুন সীমান্ত – এই ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। তিনি শুধু আমেরিকার জন্যই নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সমস্যা সমাধানে সাহসী পদক্ষেপ নিতে নাগরিকদের উৎসাহিত করেছিলেন। সেই সময়টা ছিল এক আদর্শবাদের যুগ, যেখানে সরকার এবং নাগরিক উভয়েই দেশ ও মানুষের উন্নতির জন্য নিজেদের সৃজনশীলতা, সাহস ও কল্পনাশক্তি কাজে লাগানোর অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। কেনেডির সেই সময়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলি আজও আমেরিকার সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে।
কেনেডির সময়ে, সরকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা, সুযোগের বিস্তার ঘটানো, বিজ্ঞান ও মহাকাশ নিয়ে নতুন গবেষণা করা, শান্তিরক্ষা ও যুদ্ধের সম্ভাবনা কমানো এবং অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের মতো সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তিনি ‘পিস কোর’ এবং ‘ইউএসএআইডি’-এর মতো সংস্থা তৈরি করেন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সাহায্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
প্রেসিডেন্ট কেনেডি ‘মুনশট’-এর মতো সাহসী বিজ্ঞান প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, যা জাতির কল্পনাকে জয় করে এবং আমেরিকান উদ্ভাবনের অসীম সম্ভাবনা প্রমাণ করে। তিনি মনে করতেন, সরকারের উচিত জনগণের জন্য অর্থ ব্যয় করা। দরিদ্র ও গ্রামীণ এলাকার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করা, শিক্ষার উন্নতি, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য তিনি ফেডারেল তহবিল বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন।
কেনেডির দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় যখন তিনি নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে তাঁর পুরোনো কিছু দ্বিধা থেকে সরে এসেছিলেন। তাঁর সময়ে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা আজকের দিনে ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ’-এর ভিত্তি স্থাপন করে। ১৯৬৩ সালের জুনে এক টেলিভিশন ভাষণে কেনেডি বলেছিলেন, বর্ণগত সমতা জাতির জন্য নৈতিকভাবে অপরিহার্য এবং তিনি একটি ব্যাপক নাগরিক অধিকার বিল প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর মৃত্যুর পর, কংগ্রেস সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং ১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার আইন পাস হয়।
কিন্তু ‘ক্যামেলট’-এর এই স্বপ্ন সবসময় নিখুঁত ছিল না। সেই সময়েও অনেক দুর্বলতা ছিল। তবে কেনেডির নেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কারণে এই ‘ক্যামেলট’-এর ধারণা আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে।
আজ, যখন আমরা আমেরিকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন দেখছি, তখন কেনেডির সেই আদর্শের সঙ্গে বর্তমানের অনেক পার্থক্য চোখে পড়ে। এখনকার দিনের রাজনৈতিক আলোচনা, কেনেডির সময়ের মতো নৈতিকতা এবং সাম্যের ধারণার পরিবর্তে, অনেক বেশি ব্যক্তি-স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ – এই নীতি এখন অগ্রাধিকার পায়, যা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কেনেডির সময়ে যে ‘ইউএসএআইডি’-র মতো উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি তৈরি হয়েছিল, সেগুলির গুরুত্বও বর্তমানে হ্রাস করা হচ্ছে।
কেনেডি সবসময় নাগরিকদের সাহায্য করার জন্য সরকারি কর্মসূচি বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন, কিন্তু বর্তমান সময়ে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। কেনেডি বিজ্ঞান ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিলেন, সেখানে বর্তমান প্রশাসন মনোযোগ দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, বুদ্ধিবৃত্তিবিরোধীতা এবং ব্যক্তিগতকরণের দিকে।
জন এফ কেনেডির ‘ক্যামেলট’-এর স্বপ্ন ছিল একটি উন্নত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলা। তাঁর সেই স্বপ্ন হয়তো আজও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু তাঁর আদর্শ আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন