ক্ষমা : কেন বিদ্বেষকে বিদায় জানানো উচিত
ছোট্ট একটি ঘটনার কথা মনে করুন। হয়তো কোনো বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্য, অথবা অফিসের কোনো কর্মকর্তার খারাপ ব্যবহার। এমন অনেক ঘটনাই আছে যা আমাদের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। এই ধরনের ঘটনার স্মৃতিগুলো মনের গভীরে গেঁথে যায়, যা সহজে ভুলতে পারি না আমরা।
অনেকে আছেন যারা বছরের পর বছর ধরে অতীতের কোনো ঘটনার জন্য প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকেন। কিন্তু জানেন কি, এই বিদ্বেষের মনোভাব আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর?
সম্প্রতি, মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বিদ্বেষ বা ঘৃণা আমাদের মনকে দুর্বল করে দেয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্বেষ পুষে রাখেন, তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং এমনকি হৃদরোগের মতো শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির (Stanford University) ‘ফরগিভনেস প্রজেক্ট’-এর পরিচালক এবং মনোবিজ্ঞানী ফ্রেড লাসকিনের মতে, অল্প সময়ের জন্য রাগ বা ঘৃণা অনুভব করা স্বাভাবিক, কারণ এটি আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন (Dopamine) নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে, যা সাময়িক আনন্দের অনুভূতি দেয়। কিন্তু যখন এই বিদ্বেষ দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়, তখনই সমস্যা শুরু হয়।
উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Wisconsin-Madison) শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট এনরাইট (Robert Enright) মনে করেন, স্বল্প মেয়াদে রাগ হওয়াটা খারাপ নয়। কারণ, এটি আমাদের আত্ম-সম্মানবোধকে টিকিয়ে রাখে।
তবে, যদি আমরা সতর্ক না হই, তবে এই রাগ ধীরে ধীরে বিদ্বেষে পরিণত হতে পারে। তিনি বলেন, বিদ্বেষ অনেকটা অপ্রত্যাশিত অতিথির মতো, যে সহজে যেতে চায় না। এটি আমাদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে এবং উদ্বেগের জন্ম দেয়।
তাহলে, এই বিদ্বেষ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?
- অনুভূতির গভীরে যান: প্রথমে, যে ঘটনার কারণে আপনি কষ্ট পেয়েছেন, সেই বিষয়ে ভালোভাবে চিন্তা করুন। আপনার রাগ বা দুঃখের কারণগুলো চিহ্নিত করুন।
- ক্ষমা করার চেষ্টা করুন: ক্ষমা করা কঠিন হতে পারে, কিন্তু এটি আপনাকে মুক্তি দিতে পারে। যারা আপনার প্রতি অন্যায় করেছে, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করুন। তাদের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করুন।
- নিজেকে সময় দিন: ক্ষমা করার জন্য সময় লাগে। তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
- অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন: অন্যের ভুলগুলোকে ক্ষমা করার চেষ্টা করুন। সবারই ভুল করার সম্ভাবনা থাকে।
- অতীতে আটকে থাকবেন না: অতীতের ঘটনাগুলো নিয়ে বেশি চিন্তা না করে ভবিষ্যতের দিকে মনোযোগ দিন। নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টা করুন।
লন্ডনের (London) ‘চেলসি সাইকোলজি ক্লিনিক’-এর পরিচালক এবং পরামর্শক মনোবিজ্ঞানী, ড. এলিনা টুরোনি (Elena Touroni) বলেন, বিদ্বেষ আমাদের মানসিক স্থান দখল করে নেয়। অতীতের দুঃখ নিয়ে চিন্তা করলে আমরা সেই ঘটনাগুলোকেই বারবার অনুভব করি, যা আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বাধা দেয়।
তিনি আরও বলেন, ক্ষমা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানসিক চাপ কমায়, ঘুমের উন্নতি ঘটায় এবং উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কমাতে সাহায্য করে।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট (Clinical Psychologist) লিন্ডা ব্লেয়ার (Linda Blair) মনে করেন, বিদ্বেষ সাধারণত এক ধরনের কঠোরতা থেকে জন্ম নেয়। আমরা যখন মনে করি কেউ আমাদের নিয়ম ভেঙেছে, তখনই আমাদের মধ্যে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, নিজের প্রতি দয়াশীল হওয়া উচিত। যদি আপনি অনুভব করেন যে আপনি ভুল করেছেন, তবে ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা তৈরি করুন।
বিদ্বেষ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব নয়। ক্ষমা করার মাধ্যমে আপনি নিজের মনকে শান্ত রাখতে পারেন এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। মনে রাখবেন, ক্ষমা শুধু অন্যের জন্যই নয়, এটি আপনার নিজের মানসিক শান্তির জন্যও জরুরি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান