অসহায় জীবন থেকে ঘুরে দাঁড়ানো: কিভাবে এক নারীর জীবনে আলো এনেছিলেন এক অচেনা নারী।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনির রাস্তায় তখন এক তরুণীর জীবন অন্ধকারে ঢাকা। দারিদ্র্য, মাদকাসক্তি আর একাকিত্ব—এসবই যেন তার নিত্যদিনের সঙ্গী। নাম অ্যাঞ্জেলা উইলিয়ামস, বয়স ছিল উনিশ।
সেই বয়সেই তিনি ছিলেন গৃহহীন এবং হেরোইন নামক এক ভয়ংকর নেশার শিকার। তার ছোট্ট শিশু সন্তানটি থাকত মায়ের কাছে, যিনি নিজেও অ্যাঞ্জেলার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না।
কঠিন শৈশব আর পরিবারের অত্যাচারের শিকার হয়ে অ্যাঞ্জেলা যখন ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসেন, তখন থেকেই তার জীবন যেন এক গভীর খাদে তলিয়ে যেতে শুরু করে।
১৯৯৬ সালের সেই সময়ে, যাদের সঙ্গে মাদক নিতেন, তাদের সঙ্গেই কোনোমতে দিন কাটছিল অ্যাঞ্জেলার। এরপর যখন সেই সম্পর্কগুলোও ভেঙে যেতে শুরু করলো, তখন তিনি আশ্রয় নিলেন অন্য কোথাও।
এক সময় এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, যার সঙ্গে মাদক নিতেন তিনি। দুজনেই মিলে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেন, কারণ তাদের কাছে বেঁচে থাকার কোনো আশা ছিল না। কিন্তু সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি।
অ্যাঞ্জেলাকে ভর্তি হতে হয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, যেখানে তার যাওয়ার আর কোনো জায়গা ছিল না।
ঠিক তখনই অ্যাঞ্জেলার জীবনে এক দেবদূতের মতো আবির্ভাব হয় জোয়ানের। জোয়ান ছিলেন অ্যাঞ্জেলার এক বন্ধুর বন্ধু, যার সঙ্গে তার আগে একবারই দেখা হয়েছিল।
মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জোয়ান অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চান। অ্যাঞ্জেলা যখন অসহায়ভাবে জানায় যে, সে জানে না কী করবে, তখন জোয়ান এক অসাধারণ কাজ করেন।
তিনি অ্যাঞ্জেলাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান এবং বলেন, “এসো, আমার সাথে থাকো। আমি তোমার দেখাশোনা করব এবং আমরা তোমাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে (rehab) পাঠাবো।”
একজন অচেনা, আশ্রয়হীন, মাদকাসক্ত তরুণীকে জোয়ান নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অ্যাঞ্জেলাকে তিনি তার বাড়ির বারান্দার মেঝেতে একটি গদির উপর থাকতে দেন এবং প্রতিদিন সকালে শুকনো ফল দেওয়া গরম সুজি খেতে দিতেন।
অ্যাঞ্জেলা চাইলে জোয়ানের সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ, তিনি জানতেন, তাকে অবশ্যই এই মাদক থেকে মুক্তি পেতে হবে এবং সেই পথ দেখানোর জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন।
জোয়ান অ্যাঞ্জেলার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেন এবং সিডনির সব ডিটক্স (detox) সেন্টার ও আবাসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রের একটি তালিকা তৈরি করেন। অ্যাঞ্জেলা তার ছেলেকে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন, তাই জোয়ান বিশেষভাবে সেই পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো খুঁজে বের করেন যেখানে শিশুদের সাথে রাখা যায়।
প্রথমে অ্যাঞ্জেলাকে ঔষধযুক্ত ডিটক্সে ভর্তি করা হয়, যেখানে তাকে হেরোইন এবং মেথাডোন—উভয় নেশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর তিনি ১২ মাসের একটি আবাসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে যান, যেখানে তার ছেলেকে তার সাথে থাকার সুযোগ ছিল।
জোয়ানের এই সাহায্য অ্যাঞ্জেলার জীবন বদলে দেয়। তিনি ভালো হয়ে ওঠেন এবং তার জীবন সম্পূর্ণ নতুন মোড় নেয়। অ্যাঞ্জেলা জানান, “আগে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি যেখানে কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই কেউ আমাকে সাহায্য করেছে, যেভাবে জোয়ান আমাকে সাহায্য করেছিলেন।”
পুনর্বাসনের সময় জোয়ান কয়েকবার অ্যাঞ্জেলার সাথে দেখা করতে যেতেন, তাকে উৎসাহিত করতেন এবং কিছু পুরোনো জামাকাপড়ও দিতেন।
এরপর তাদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অ্যাঞ্জেলা প্রায়ই চান জোয়ানের কাছে ফিরে যেতে এবং তাকে বলতে, তিনি তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।
অ্যাঞ্জেলার জীবন এরপর অনেক বদলে যায়। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এমনকি তিনি শিক্ষকতা করার সুযোগও পান। তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং একটি বইও লেখেন।
অ্যাঞ্জেলা বলেন, “জীবনে খারাপ ঘটনা আসতেই পারে, কারণ ট্রমা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। তবে আমি আমার ছেলের সঙ্গে সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছি।”
অ্যাঞ্জেলার ছেলে এখন ত্রিশ বছরের যুবক এবং এখনো তার সঙ্গেই থাকে। তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। অ্যাঞ্জেলার কথায়, “জোয়ান শুধু আমার জীবন বাঁচাননি, তিনি আমার ছেলের জীবনও বাঁচিয়েছিলেন।”
জোয়ানের আগে, অ্যাঞ্জেলা যেন সমাজের চোখে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, যা প্রায়ই গৃহহীন মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে। জোয়ান অ্যাঞ্জেলার মাদকাসক্তি বা গৃহহীনতা দেখেননি। তিনি দেখেছিলেন একজন মানুষ, যিনি মানসিক আঘাতের শিকার।
জোয়ান অ্যাঞ্জেলাকে একটি নিরাপদ আশ্রয় দেন, তাকে ভালো থাকার কথা বলেন এবং ভবিষ্যতের জন্য আশা খুঁজে পেতে সাহায্য করেন।
অ্যাঞ্জেলার বয়স এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি এবং তিনি বিগত ত্রিশ বছর ধরে জোয়ানের মতো হওয়ার চেষ্টা করছেন। অ্যাঞ্জেলা জানান, “যখন আমি দুঃখ পাই, তখন আমি আমার জন্য রাতের খাবারে সুজি তৈরি করি। জোয়ানের মতো করে শুকনো ফলগুলো কেটে বাটিতে রাখি। কারণ, ওটাই আমার নিরাপদ আশ্রয়।”
তথ্য সূত্র: The Guardian