হারানো বাঁশি, অপ্রত্যাশিত আশ্রয়: এক অচেনা মানুষের মহানুভবতা
জীবন যেন এক নদীর মতো, কখন যে কোন দিকে মোড় নেয়, তা বলা কঠিন। সিডনির এক ব্যস্ত দুপুরে, ট্রেনের ভিড়ে ঘটে যাওয়া এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা আজও আমার মনে গেঁথে আছে। ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগের।
আমি তখন সবেমাত্র একুশ বছর বয়সী এক তরুণ, সিডনির একটি পাব-এ কাজ করি। আমার জীবনের একমাত্র আশ্রয় ছিল আমার বাঁশি, যা আমি ষোল বছর বয়সে অনেক কষ্টে জমানো সামান্য কিছু টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বাঁশি বাজালে যেন আমার ভেতরের সব কষ্ট, সব দ্বিধা দূর হয়ে যেত।
একদিন, পাব-এ কাজ করার সময়, এক বন্ধু জানতে চাইল, “আজ রাতে কী করছিস?” আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, “আজ রাতে বাঁশি বাজাতে যাবো…” কিন্তু পরক্ষণেই আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সেদিন সকালে ট্রেন থেকে নামার সময় আমি আমার বাঁশিটি নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
মুহূর্তের মধ্যে আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। এত রাগ হলো যে, হাতে ধরা প্লাস্টিকের চেয়ারটি ছুঁড়ে মারলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ছুটলাম রেলস্টেশনে, যদি বাঁশি জমা পড়ে থাকে। সেখানে গিয়ে শুনলাম, কেউ জমা দেয়নি। তবুও আমি আমার ফোন নম্বর দিয়ে এলাম, যদি পাওয়া যায়।
পরের সপ্তাহটা কাটল হতাশায়। নিজেকেই দোষারোপ করতে লাগলাম, আর বন্ধুদের সাথে বসে দুঃখ করতে লাগলাম। এর কয়েকদিন পর সিটিরেলের একজন ফোন করে জানালেন, আমার বাঁশি পাওয়া গেছে।
আমি ছুটে গেলাম সেন্ট্রাল স্টেশনের হারানো জিনিসের অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখি, আমার বাঁশিটা অন্যান্য ব্যাগ আর ছাতার ভিড়ে রাখা। বাঁশি হাতে নিতে গেলে সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীরা আমার পরিচয়পত্র দেখতে চাইলেন। আমি তখন নিউজিল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলাম। আমার কাছে ছিল শুধু একটা মেয়াদ উত্তীর্ণ পাসপোর্ট, যা ছিল আমার বাবা-মায়ের কাছে।
আমি বললাম, “আমার কাছে কোনো আইডি নেই, আর এখন আইডি জোগাড় করাও বেশ কঠিন।” তারা বলল, “তাহলে দুঃখিত, আইডি ছাড়া আমরা বাঁশি ফেরত দিতে পারব না।”
তখন আমার মাথায় অন্য কোনো উপায় ছিল না। আমি বললাম, “আমি যদি একটা গান বাজাই?”
আমি বাঁশি বের করলাম, জোড়া দিলাম, আর বাজালাম ‘গ্রিনস্লিভস’। আমার ভালোবাসার জিনিস ফিরে পাওয়ার তীব্র অনুভূতি, আর এতদিনের না পাওয়ার কষ্ট যেন সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হলো। আমার মনে হয়, নিরাপত্তারক্ষীদের চোখেও জল এসে গিয়েছিল। আমার তো এসেছিলই।
তারা মুগ্ধ হয়ে বলল, “এই তো, আপনার বাঁশি।” আমি কোনো পরিচয়পত্র ছাড়াই বাঁশি নিয়ে চলে এলাম। এটা ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রথমে সেই ব্যক্তির কৃতজ্ঞতা, যিনি আমার বাঁশিটি খুঁজে ফেরত দিয়েছিলেন, আর পরে নিরাপত্তারক্ষীদের এই মানবিক আচরণ, যা আমাকে আজও মুগ্ধ করে।
বড় শহরগুলোতে প্রায়ই শোনা যায়, এখানে মানুষের মধ্যে কোনো সহানুভূতি নেই, সবাই শুধু নিজের স্বার্থ দেখে। কিন্তু আমি আমার জীবনে অনেক কঠিন সময় পার করেছি। এমনকি, একসময় আমার থাকার জায়গাও ছিল না। রাস্তায় বাজালেও মানুষজন আমার প্রতি সব সময়ই সহানুভূতি দেখিয়েছে।
আমার মনে হয়, মানুষ হিসেবে আমরা একে অপরের প্রতি দয়ালু হতে পারি, বিশেষ করে যাদের কাছ থেকে আমাদের কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই তাদের প্রতিও। সেই রেলস্টেশনের ঘটনার পর থেকে, আমি সব সময় চেষ্টা করি কারো কোনো জিনিস পেলে তা ফেরত দেওয়ার। কারণ, আমি সেই অজানা ব্যক্তির কাছে চিরকৃতজ্ঞ, যিনি আমার বাঁশি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান