দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপের প্রবীণ একদল নারীর জীবনযাত্রা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের কাছে এক গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই নারীরা, যাদের স্থানীয় ভাষায় ‘হাইন্যো’ বলা হয়, কোনো রকম অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই গভীর সমুদ্রের তলদেশে ডুব দেন এবং জীবিকা নির্বাহ করেন।
সম্প্রতি, তাঁদের এই ব্যতিক্রমী জীবনযাত্রা এবং শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে নতুন কিছু তথ্য উঠে এসেছে।
হাইন্যো’রা মূলত ৭০ বছর বয়সী নারী, যারা বছরের পর বছর ধরে, এমনকি সন্তানসম্ভাবা অবস্থায়ও, গভীর সমুদ্র থেকে শামুক ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্য সংগ্রহ করে আসছেন। তাঁদের এই কাজটি সহজ নয়।
তীব্র ঠান্ডায় (প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুব দিয়ে তাঁরা কাজ করেন। পানির গভীরতা ১০ মিটারের বেশিও হতে পারে।
দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাস ধরে রাখার ক্ষমতা তাঁদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলে। এই ঐতিহ্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একেবারে বিরল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা একটি মাতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
ইউনিভার্সিটি অফ ইউটাহ-এর একজন জেনেটিসিস্ট, মেলিসা ইলার্ডো এই হাইন্যো নারীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তাঁর মতে, হাইন্যোদের এই অসাধারণ ক্ষমতা শুধু প্রশিক্ষণের ফল নয়, বরং সম্ভবত তাঁদের জিনগত বৈশিষ্ট্যেরও একটি প্রতিফলন। ‘সেল রিপোর্টস’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানা যায়, হাইন্যো নারীদের শরীরে এমন কিছু জিনগত পরিবর্তন হয়েছে, যা তাঁদের ঠান্ডা পানিতে দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকতে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, হাইন্যো নারীদের হৃদস্পন্দন অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি কমে যায়, যা তাঁদের দীর্ঘক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে সহায়তা করে।
এছাড়াও, তাঁদের শরীরে এমন কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
এটি বিশেষ করে সন্তানসম্ভবা হাইন্যোদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁরা সাধারণত সন্তান জন্ম দেওয়ার আগ পর্যন্ত ডুব দেন। এই জিনগত পরিবর্তন তাঁদের প্রিক্ল্যাম্পসিয়া (Preeclampsia) সহ গর্ভাবস্থার জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে।
জেজু দ্বীপের হাইন্যোদের জীবনযাত্রা শুধু তাঁদের নিজেদের জন্য নয়, দ্বীপের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপরেও প্রভাব ফেলে।
ইলার্ডোর মতে, এই নারীদের জীবনযাত্রা হয়তো দ্বীপের মানুষের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের শরীর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, যা এই হাইন্যো নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দৃশ্যমান।
ফিনল্যান্ডের তুষার যুগের শিকারী এবং ইন্দোনেশিয়ার ‘বাজাউ’ সম্প্রদায়ের ডুবুরিদের শরীরেও অনুরূপ অভিযোজন লক্ষ্য করা গেছে।
বাজাউ সম্প্রদায়ের ডুবুরিদের প্লীহা আকারে বড় হয়, যা তাদের ডুব দেওয়ার সময় বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে সহায়তা করে।
হাইন্যো নারীদের নিয়ে গবেষণা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়ছে।
মানুষের শরীর কীভাবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খায়, তা বোঝা ভবিষ্যতের জন্য জরুরি।
সম্ভবত, হাইন্যো নারীদের শরীরচর্চা এবং জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যখাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
তবে, এই ঐতিহ্য বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
তাই, হাইন্যোদের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি, যা ভবিষ্যতের জন্য মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক