শিরোনাম: দুর্যোগের পরে ঘুরে দাঁড়ানো: আঘাত থেকে উত্তরণের পথ।
বাংলাদেশে, প্রকৃতির রুদ্র রূপ প্রায়ই আমাদের জীবনে আঘাত হানে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমরা বিপর্যস্ত হই, হারাই প্রিয়জন, ঘরবাড়ি—যেন এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয় মনে।
কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে কি মুক্তি নেই? মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আছে। তারা একে ‘পোস্ট-ট্রমাটিক গ্রোথ’ বা আঘাত পরবর্তী উন্নতি (শারীরিক আঘাত পরবর্তী উন্নতি) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর মার্সাল ফায়ারের কথা ভাবুন। ২০২১ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, এরিকা সোলোভের জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল। ভয়াবহ ঝোড়ো হাওয়ার মাঝে তার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, কেড়ে নিয়েছিল সবকিছু।
সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তার মনে আছে। তবে, তিন বছর পর, এরিকা একজন শক্তিশালী মানুষে পরিণত হয়েছেন। তিনি এখন অন্যদের জন্য কাজ করেন, যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিখেছেন, কীভাবে এই আঘাত কাটিয়ে ওঠা যায় এবং জীবনের নতুন দিক খুঁজে পাওয়া যায়।
আঘাত পরবর্তী উন্নতি (শারীরিক আঘাত পরবর্তী উন্নতি) মানে কেবল কষ্টের স্মৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া নয়, বরং জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাওয়া। এটা হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ ট্রমা বা মানসিক আঘাতের পর আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
তারা নিজেদের আত্ম-প্রত্যয়ী ও আত্ম-নির্ভরশীল হিসেবে আবিষ্কার করে। এর ফলে জীবনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়, সম্পর্কগুলো আরও গভীর হয়, এবং জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা বাড়ে।
এই পরিবর্তনের পথে কয়েকটি বিষয় সাহায্য করতে পারে। প্রথমত, আঘাত সম্পর্কে সচেতনতা ও এর সম্ভাব্য ভালো দিকগুলো খুঁজে বের করা। আমাদের সমাজে, অনেক সময় ধর্মীয় বিশ্বাস বা নৈতিকতার মাধ্যমে এই ধরনের উপলব্ধির চেষ্টা করা হয়।
দ্বিতীয়ত, মানসিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণ। দুঃখ ও কষ্টের অনুভূতিগুলো চেপে না রেখে, তাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। ধ্যান বা প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটানো এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
তৃতীয়ত, নিজের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের সাথে শেয়ার করা। কাউকে নিজের কথা খুলে বলা, ডায়েরিতে লেখা, গান বা কবিতার মাধ্যমে অনুভূতি প্রকাশ করা—এগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
চতুর্থত, নিজের জীবনের গল্পটিকে নতুনভাবে সাজানো। কঠিন পরিস্থিতিগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। একজন থেরাপিস্ট, বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের সাথে আলোচনা করে এই কাজটি করা যেতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সমাজের সমর্থন। পরিবার, বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সহযোগিতা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে দৃঢ় করতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সামাজিক বন্ধন এবং সম্প্রদায়ের সহযোগিতা একটি বিশাল শক্তি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াই, ত্রাণ বিতরণ করি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সাহায্য করি। এই ধরনের সহযোগিতা আঘাত পরবর্তী উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সোলোভের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখায়, জীবনের কঠিন সময়েও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের সম্পর্কের গভীরতা, মানসিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যদের সাহায্য করার মানসিকতা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্যোগ আসবেই, কিন্তু আমরা একা নই। সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সব বাধা পেরিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারি।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক